একমনে কাঠ খোদাই করে চলেছেন এক প্রৌঢ়। নিপুণ হাত ফুটিয়ে তুলছে একটা আস্ত অবয়ব। একেবারে নিখাদ শিল্প; তাও মুখ ভার প্রৌঢ়ের। তৈরি তো হচ্ছে সব, কিন্তু বিক্রির মুখ যে দেখছে না। এসবই কাঠের পুতুল, একসময় রমরমিয়ে বিক্রি বাট্টা চলত। শুধু কি তাই, গ্রাম বাংলায় ঘুরে ঘুরে বসত পুতুল নাচের আসর। কিন্তু আজ? প্রযুক্তি ও আধুনিকতার থাবা এইসব সাঁওতালি গ্রামে এসে আঘাত করেছে। ফলে ক্রমশ উল্টে পড়ছে সেখানকার লক্ষ্মীর ভাঁড়ার। থেমে যাচ্ছে একটা সুপ্রাচীন শিল্প…
তখনও টিভির প্রচলন হয়নি। ফোন তো দূরস্ত। সন্ধ্যের পর গ্রামের তুলসিতলায় জ্বলে উঠত প্রদীপ; আর ঘরে ঘরে হ্যাজাক বা হ্যারিকেন। অর্থাৎ এক কথায়, আয়োজন ছিল অত্যন্ত কম ও সাধারণ। আর এই সাধারণ জীবনেই টাটকা বাতাস হয়ে আসত নানা বিনোদনের উপকরণ। তাদেরই অন্যতম ছিল এই পুতুল নাচ। সামান্য স্টেজ খাটিয়ে, কারিগরদের হাতের কারসাজিতে প্রাণ পেত কাঠের পুতুলগুলো। রং-বেরঙের কাপড় পরে ঝলমল করে উঠত গোটা এলাকা। কখনও মেলায়, কখনও বা এমনিই মাঠে শুরু হয়ে যেত এই অনুষ্ঠান।
আর এই শিল্পেই রীতিমতো কদর ছিল সাঁওতালদের। সেখানকার সাঁওতালি পুতুল নাচ ছড়িয়ে পড়ত সমস্ত জায়গায়। তাঁদের ‘চাদর-বাঁধনী’ নাচ ও চদর-বদর পুতুলের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। সাঁওতালদের নানা লোকাচার, লোককথা ফুটিয়ে তোলা হত এই নাচে। লোকের মুখে মুখে ফিরত সেসব কাহিনি। পুতুলের বায়নাও ছিল বিশাল। বিশেষ করে পুজোর সময় এই পুতুল নাচ দেখানোর চল বেড়ে যেত অনেক। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, একটা সময় আশেপাশের রাজ্যেও চলে যেত এই শিল্পীরা। কংকালীতলা, নিমডাঙা, কামারপাড়া ইত্যাদি গ্রামগুলি রীতিমতো বিখ্যাত ছিল কাঠের পুতুলের জন্য।
তবে আজ আর সেই ছবি নেই। এখন আর তেলের কুপি জ্বলে না। সবকিছু নাকি আধুনিক হয়ে যাচ্ছে। আর সেই আধুনিকতার ‘দাপটে’ মার খাচ্ছে এই পুতুল শিল্পীরা। চদর-বদর পুতুল আর আগের মতো বায়না করে না কেউ। করলেও, এই কাজ সব জায়গায় পৌঁছয় না। নবীন প্রজন্মও যে এসব নিয়ে খুব আগ্রহী, তা নয়। সরকারি, বেসরকারি কোনো স্তর থেকেই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে, একপ্রকার অন্ধকারেই পড়ে আছে পুতুল নাচ। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এককালের জনপ্রিয় লোকশিল্প।
Powered by Froala Editor