’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তথ্যচিত্র, পরিচালনায় ঋত্বিক ঘটক; দেখুন সেই দুষ্প্রাপ্য দলিল

শান্ত দুপুর, থেকে থেকে ঘুঘু ডাকছে। মাথার ওপর গনগনে রোদ। চারদিক বীভৎস রকমের থমথমে। তারই মধ্যে একজন হেঁটে আসছে দূর থেকে। একজন সৈনিক; হাতে বেয়নেট লাগানো বন্দুক। টলতে টলতে দাঁড়িয়ে পড়ল একটি পাথুরে জায়গায়। চোখ উঠে গেল অপরের দিকে। আপনাআপনিই কপালে চলে গেল হাত। স্যালুটের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ওপরে একটা কাপড় উড়ছে। কাপড় না, একটা পতাকা। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা। একটি স্পর্ধার পতাকা। দৃশ্যের পেছনে লেখা, ‘বাংলাদেশ সীমান্ত, জয় বাংলা’…

১৯৪৭-এর পর থেকে ওপার বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনের লড়াই শুরু হয়। সেই কাহিনিই বারবার পর্দায় ফিরে ফিরে এসেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার গল্প এপারেও একজনকে তাড়িত করেছে প্রবলভাবে। যিনি নিজের জীবৎকালে কখনও দেশভাগ মানেননি। ‘বাংলার এপার-ওপার’ এই ব্যাপারটাই তাঁর কাছে অদ্ভুত আর নিষ্ঠুর লাগত। ঋত্বিক ঘটকের কাছে গঙ্গা এবং পদ্মা যে একই আত্মার দুই নাম! কিন্তু বাস্তবকে যে মেনে নিতেই হয়। সেই যুদ্ধেরই একটি ছোট্ট অংশ, সেই সময়ের ওপার বাংলার চিত্র তিনি তুলে ধরেছিলেন ক্যামেরায়। তৈরি করেছিলেন একটি বিশেষ তথ্যচিত্র ‘দুর্বার গতি পদ্মা’। ১৯৭১ সালেই যা মুক্তি পেয়েছিল… 


ভাষা সংগ্রাম থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ— বাংলাদেশের ইতিহাসের এই বিস্তৃত অধ্যায়কে এক ফ্রেমে আনা সহজসাধ্য কাজ নয়। তবে শুধু কি বাংলাদেশ? ওখানকার আন্দোলনের ঢেউ তো ছুঁয়ে গিয়েছিল কলকাতাকেও। এখানকার রাস্তাতেও উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। শোনা গিয়েছিল জয় বাংলা ধ্বনি। শেখ মুজিবের নাম ছড়িয়েছিল শহরের রাস্তায়। সঙ্গে ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের ছবি। প্রতিবাদে মিশে গিয়েছিল দুই বাংলা। সেই ছবিই উঠে এসেছিল ঋত্বিকের ক্যামেরায়। তথ্যচিত্রটির কথা সেরকমভাবে লোকের কাছে পৌঁছয়ওনি। কয়েক বছর আগে পুনরুদ্ধার করে এর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঐতিহাসিকভাবে তো বটেই, আরও একটা কারণে এই তথ্যচিত্র গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই প্রথমবার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ব্যবহার করা হয়। ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়’— বহুবার এই কবিতাটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আমরা। বাংলার সিনেমার জগতেও ব্যবহৃত হয়েছে অনেকবার। সেই সূচনাটি ঘটেছিল এই তথ্যচিত্রটির হাত ধরে। স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক নিজে পাঠ করেছিলেন এই কবিতাটি।  

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন ভারতের তাবড় তাবড় শিল্পীরা। অনেকেই হাজির হয়েছিলেন সেই দেশে। একদিকে গান গাইছেন, অন্যদিকে হাসপাতালে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন শয়ে শয়ে মানুষ। দাঁড়িপাল্লার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ঢেকে যাচ্ছে তাঁদের আর্তনাদ। তথ্যচিত্রটি শেষ হচ্ছে অভিনেতা বিশ্বজিতের কথা দিয়ে- ‘এখানেই কি আমরা থামব মশাই?’ সত্যিই কি তাই? আমরা কি ওখানেই থেমে আছি? দেশভাগেই থেমে বসে আছি? এই প্রশ্ন ঋত্বিকের তো বটেই, আমাদেরও কি নয়… 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় ও একটি 'আকাশ কুসুম' বিতর্ক

Latest News See More