সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা। দমদমে ম্যানহোল পরিষ্কার করতে নেমে থেমে গিয়েছিল চার চারটি প্রাণ। পুলিশ, দমকল পৌঁছানোর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সবকিছু। তবে দমদমের এই ঘটনা কোনো বিক্ষিপ্ত দুর্ঘটনা নয়। দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই কিংবা হায়দ্রাবাদের মতো মেট্রো শহরগুলোতে লেগেই রয়েছে সাফাইকর্মীদের অপমৃত্যু। আর তার শিকার হচ্ছেন মূলত তফসিলি (Schedule Caste And Tribes) সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা। সম্প্রতি, খোদ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যতেই স্পষ্ট ফুটে উঠল বর্ণবিভাজন ও জাতিবিভাজনের বাস্তব প্রেক্ষাপট।
সম্প্রতি, রাজ্যসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রী রামদাস আথাওয়ালে জানালেন, বর্তমানে ভারতবর্ষে কর্মরত ম্যানুয়েল স্ক্যাভেঞ্জারের (Manual Scavengers) সংখ্যা ৪৩ হাজার ৭৯৭। যাঁদের মধ্যে ৪২ হাজার ৫৯৭ জন কর্মীই হলেন তফসিলি সম্প্রদায়ের, ৮৫২ জন তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত। দেখতে গেলে, ম্যানহোল কিংবা সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কাজে নিযুক্ত করা সাফাইকর্মীদের ৯৯ শতাংশেরও বেশি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষ। যেন এই কর্মক্ষেত্রের সমস্ত পদ সংরক্ষিত রয়েছে শুধু তাঁদের জন্যই। অথচ, এক্ষেত্রে একবারও উঠছে না সমানাধিকারের প্রশ্ন।
‘ম্যানুয়েল স্ক্যাভেঞ্জার’ বা ‘সুয়ার ক্লেন্সিং মজদুর’। এই বিশেষ কর্মীপদটির জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। আর সেই পদ ১০০ শতাংশ সংরক্ষিত ছিল পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরদের জন্য। স্বাধীনতার পর দেশের সমস্ত কর্মক্ষেত্রের খোলনলচে বদলে গেলেও, বিন্দুমাত্র বদলায়নি প্রশাসনের সেই মানসিকতা। সেই অলিখিত নিয়ম রাজত্ব করে চলেছে আজও। প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়েও যন্ত্রায়ণ নৈব নৈব চ।
১৯৯৪ সালে, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই দানা বাঁধতে শুরু করে সাফাইকর্মীদের আন্দোলন। দীর্ঘ দু’দশক পর ২০১৩ সালে সাফল্যও আসে সেই প্রতিবাদে। মানুষকে ম্যানহোলে নামিয়ে বর্জ্য নিষ্কাষনের প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। স্ক্যাভেঞ্জিং-এর কাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয় সরকারকে। কিন্তু আট বছর পেরিয়ে এসেও সেই আইন থেকে গেছে খাতায় কলমেই। মেট্রো শহরগুলির পৌর কর্তৃপক্ষ কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সুয়ার যন্ত্র আমদানি করলেও, তার প্রায় ব্যবহার হয় না বললেই চলে। পাশাপাশি, কর্মচারীদের বিকল্প আয়ের কোনো নির্দিষ্ট হদিশ দিতেও ব্যর্থ প্রশাসন।
আরও পড়ুন
আড়াই দশক ধরে উপেক্ষার শিকার মুম্বাইয়ের সাফাইকর্মীরা, প্রতিবাদে হয়েছে জেলও!
আইন তো দূরের কথা, ন্যূনতম সাবধানতাও অবলম্বন করা হয় না অধিকাংশক্ষেত্রেই। গামবুট, মাস্ক, গ্লাভস, অ্যাপ্রন, এমনকি কোমরের সুরক্ষা দড়িটুকুও থাকে না সাফাইকর্মদের কাছে। কর্মীদের নামানোর আগে, ম্যানহোলে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতিটুকুও পরীক্ষা করেও দেখা হয় না। অনেকক্ষেত্রেই যা শ্বাসরোধে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় সাফাইকর্মীদের।
আরও পড়ুন
অবসরের আগে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে মূল্যবোধ শিখিয়ে চিঠি সাফাইকর্মীর
তবে আরও চাঞ্চল্যকর বিষয় হল, ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলা একের পর এক দুর্ঘটনার পরেও গত জুলাই মাসে কেন্দ্রের প্রকাশিত তথ্য জানাচ্ছে, বিগত এক বছরে কোনো সাফাইকর্মীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি ভূভারতে। অথচ, রাজ্য বা শহরভিত্তিক রিপোর্টই বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এও কি প্রহসন নয়? নাকি এই পেশার সঙ্গে নিম্নবর্ণের মানুষেরা জড়িয়ে আছেন বলেই হেলায় উপেক্ষা করে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে এমন একটি গুরুতর বিষয়? বর্তমান এই প্রেক্ষাপট যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে আম্বেদকরের বিখ্যাত মন্তব্যটির কথা। “কাস্ট ইজ নট জাস্ট ডিভিশন অফ লেবার, ইট ইজ দ্য ডিভিশন অফ লেবারারস।”
আরও পড়ুন
আইনি নিষেধাজ্ঞার ৭ বছর, আজও ‘স্বাভাবিক’ সাফাইকর্মীদের মৃত্যু
Powered by Froala Editor