আরও সরাসরি, আরও অপ্রত্যাশিতভাবে মতপ্রকাশ এবং বাকস্বাধীনতার উপরে আঘাত হানতে চাইল কেন্দ্রীয় সরকার। ‘প্রভাবশালী’ সোশ্যাল মিডিয়ার যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে দরবার করল সুপ্রিম কোর্টের কাছে। দাবি জানাল, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার থেকে অনেক বেশি প্রভাব বর্তমান যুগে ডিজিটাল মিডিয়ার। তাই গাইডলাইন যদি তৈরি করতেই হয়, তাহলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আগেও তা তৈরি করা উচিত ডিজিটাল মিডিয়ার জন্য, এমনই অভিমত কেন্দ্রের।
সম্প্রতি ইউপিএসসি পরীক্ষায় মুসলিমদের নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কিছু বিতর্কিত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়েছিল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে। সেই সম্প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল আদালত। টিআরপির জন্য ক্ষুধার্ত ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে যথেষ্ট ভর্ৎসনাও সহ্য করতে হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যেভাবে মিডিয়া লাগাতার বিচার পর্ব চালিয়ে আসছিল একাধিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে নিন্দা করা হয় তাকেও। টিআরপি বুভুক্ষু মিডিয়ার নির্লজ্জ পেশাদার রূপটাই যেন আরও বেশি নগ্ন হয়ে বেরিয়ে এসেছিল এই ঘটনায়।
এরই প্রেক্ষিতে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য গাইড লাইন তৈরি করতে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি পরামর্শ দিয়েছিল আদালত। বাস্তবিকভাবেই এর অত্যন্ত প্রয়োজনও ছিল। কারণ যেভাবে দিনের পর দিন বেলাগাম হয়ে পড়ছিল ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, নানান অজুহাতে নিশানা করা হচ্ছিল নির্দিষ্ট কিছু জাতি বা সম্প্রদায়কে, তাতে চ্যানেলের টিআরপি বেড়ে চললেও কখনও কখনও যে তা অশ্লীল এবং অশ্রাব্য জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। এমনকি টিভি চ্যানেলের সৌজন্যে স্থানীয় ভাবে অশান্তি ছড়াতেও দেখা গিয়েছিল কোথাও কোথাও। সর্বোপরি ঘরে ঘরে কেবল লাইন এবং টেলিভিশনের দৌলতে শিশুদের কাছেও বাইরের পৃথিবী এখন খোলা জানালার মতো। সুতরাং শিশুমনে এইসব ঘটনার বিরূপ প্রভাব পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাই আদালতের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় ছিল না কোনও।
কিন্তু তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার কেন উঠে পড়ে লাগল আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে? জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার যে যুক্তি উঠিয়ে এনেছে, তা যেন ঘুরিয়ে আঙুল তুলছে ক্ষমতাসীন দলের দিকেই। সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া কেন্দ্রের হলফনামায় বলা হয়েছে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ডিজিটাল মিডিয়া অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের কাছে। স্বাভাবিকভাবেই জনসমাজে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে এইসব সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল পৃথিবী। তাই টেলিভিশন মিডিয়ার আগেও ডিজিটাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত প্রধান আদালতের।
আরও পড়ুন
লকডাউনে খাদের কিনারায় দলিত, মুসলিম এবং আদিবাসীরা, পৌঁছোয়নি ত্রাণও; প্রকাশ সমীক্ষায়
সরকারের মতে, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়া নিয়ে বহু বিতর্ক উঠলেও এখনও অবধি সেই সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিচক্ষণতা এবং দায়িত্ববোধের সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। বাকস্বাধীনতা এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, দু’টি বিষয় কখনোই একে অন্যের উল্টো পথে হাঁটে না। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই রীতিমতো লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে সোশ্যাল মিডিয়া। ভুয়ো খবর, মিথ্যা তথ্য মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে। সমাজে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে; তৈরি হচ্ছে হিংসার বাতাবরণ। গণপিটুনিতে মৃত্যুর মতো ঘটনাও নড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের বারবারই। তাই সরকারের যুক্তি অনুযায়ী, বাকি মিডিয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়াকেই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত সর্বাগ্রে।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেক নিউজ ছড়িয়ে অশান্তি তৈরি হওয়ার ঘটনাও যেমন সামনে এসেছে, তেমনই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও নিয়েছে এইসব সোশ্যাল মিডিয়াই। বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যখন চোখে কাপড় বেঁধে অথবা না দেখার ভান করে এড়িয়ে গিয়েছিল প্রচলিত সংবাদ মাধ্যমগুলি, তখন সেই সব ইস্যু নিয়ে সাধারণ মানুষকে সরব হতে দেখা গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়াতেই। উল্টোদিকে আবার এই ধরনের ফেক নিউজ বা ভুয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগ সবথেকে বেশি কিন্তু এসেছে শাসকদলের বিরুদ্ধেই। অবৈজ্ঞানিক তথা বিদঘুটে নানান তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে অথবা হোয়াটসঅ্যাপের লাখো লাখো গ্রুপে। 'হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি' তো তার নতুন আক্ষরিক অর্থ নিয়ে অবিলম্বে অভিধানে জায়গা পেল বলে! তাই প্রশ্ন উঠছে, এই বিধিনিষেধের ফলে ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ হয়ে যাবে না তো? যেখানে বিরোধীদের স্বর বুজিয়ে দিয়ে, বজায় রাখা যাবে খালি নিজের আওয়াজটুকুই!
আরও পড়ুন
১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার বা ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম ছাড়াও আরও নানান ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উপরেও নজরদারি চালানোর অভিমত পরিষ্কার করেছে কেন্দ্র। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নজরদারি চালানোর অর্থই হলো সেখানে সরকার বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী কনটেন্টের রমরমার দিন শেষ হতে চলেছে। কিছুদিন আগেই ‘পাতাললোক’ কিংবা ‘স্যাক্রেড গেমস’-এর মতো ওয়েব সিরিজে সমসাময়িক ভারতের অশান্তির কথা উঠে এলে, তাকে কিন্তু ভালো চোখে নেয়নি শাসক দল। এবং তার সঙ্গেই তো অবধারিতভাবে আসবেই সেন্সর বোর্ডের কাঁচির লাল চোখ। সুতরাং নিয়ন্ত্রণের নামে সোনায় সোহাগা!
এবং সেখানেই তৈরি হয়েছে সন্দেহ। নির্দিষ্টভাবে কোনও মিডিয়াকে আড়াল না করে কেন্দ্রের তো বরং বলা উচিত ছিল যে, যে কোনও ধরনের ভুয়ো তথ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান পরিষ্কার করুক প্রধান আদালত। মাধ্যম দেখে নয়, বরং অপরাধের বিচার হোক অপরাধের ভিত্তিতেই। কিন্তু তা না করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলিকে যেভাবে আড়াল করতে উঠে পড়ে লেগেছে সরকার, তাতে আদতে তার সৎ উদ্দেশ্য কতখানি সে নিয়ে খচখচানি একটা থেকেই যায়। কেন্দ্র যাই বলুক না কেন, বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী কার্যকলাপ পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতে দিচ্ছে কই? বরং মনে হওয়া স্বভাবিক যে, সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃ্ত্যু যেভাবে বিহার নির্বাচনের ইস্যু হয়ে গেছে মিডিয়ার দৌলতে, যেভাবে প্রোপাগান্ডা করা হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলিতে দিল্লির ছাত্রনেতার গ্রেফতারি কিংবা ইন্দো-চিন দৈরথ, তাতে টিভির উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হলে আদতে অসুবিধাটা কার, সেটা আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার দরকার পড়ে কি?
আরও পড়ুন
পাবজি-ফৌজি চর্চা, রবীন্দ্রনাথ ও কিছু 'হযবরল'
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor