‘আত্মনির্ভর ভারত’। দেশের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টায় এই বার্তা বা শব্দবন্ধ বারবারই শোনা গিয়েছে সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় সরকারের জবানিতে। কিন্তু কথায় আর কাজে যে এই সরকারের কয়েক যোজন ফারাক, সেই ঘটনা সামনে এসেছে আগেও। প্রায় চুপিসারেই কেন্দ্রীয় সরকারের আরও একটি পদক্ষেপ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তারই পুনরাবৃত্তি।
মেঘ জমা থেকে বৃষ্টি হওয়ার মতোই প্রকল্প পরিকল্পনা এবং প্রকল্পের বাস্তবায়নের মাঝে থাকে একাধিক কার্যকরী পদক্ষেপ। তাছাড়া শুধু কাগজে কলমে যে কোনও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ফাইলবন্দি হয়ে থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক। প্রায় চুপিসারেই দেশের অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ কুটির শিল্পের প্রতি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণ তাই ঠিক কতটা আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলার পথে কার্যকর, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কারণ এই লকডাউন সময়ের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে গেল হ্যান্ডলুম বোর্ড এবং হ্যান্ডিক্রাফট বোর্ড। শুধু ভারতেই নয়, বিদেশেও দেশীয় শিল্পীদের হাতে তৈরি তাঁত এবং হস্তশিল্পকে টিকিয়ে রাখা এবং তার প্রসারের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বে ছিল এই বোর্ডগুলি। কেন্দ্র সরকারের এই সিদ্ধান্তে এক ধাক্কায় আর অস্তিত্ব রইল না সেগুলির।
গত ৭ আগস্ট কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি জাতীয় হ্যান্ডলুম ডে উদযাপন করতে দেশের একাধিক সেলিব্রিটির সঙ্গে হ্যান্ডলুম বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় ছবি শেয়ার করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু তার আগেই ২৭ জুলাই এবং ৩ আগস্ট কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে হাওয়া হয়ে গিয়েছে হ্যান্ডলুম এবং হ্যান্ডিক্রাফট বোর্ড। এর পিছনে সরকার যে যুক্তিগুলি দিয়েছে, তাকে পর্যায়ক্রমে সাজালে তিনটি মূল বিষয় উঠে আসে। এক, সামগ্রিকভাবে কুটির শিল্পের উন্নয়ন। দুই, শিল্পের মান বজায় রাখা এবং তিন, আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতির আধারটিকে বজায় রাখা এবং সরকারি হস্তক্ষেপ কমিয়ে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সুবিধা প্রদান। কিন্তু সারা ভারত জুড়ে তাঁতি এবং কারিগরদের সমন্বয়ে ৮৮টি বেসরকারি সংস্থা এবং সদস্যদের একমাত্র সংগঠন ছিল এই হ্যান্ডলুম বোর্ড। সুতরাং ব্যবহারিকভাবে এটি একমাত্র ফোরাম ছিল যেখানে স্টেকহোল্ডাররা সরাসরি তাদের বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া জানাতে পারত সরকারকে। দেশের তাঁত শিল্পের উন্নয়ন এবং প্রসারে কয়েক দশক আগে এই সদর্থক পদক্ষেপটিই বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দিয়েছিল কুটির শিল্পে বিনিয়োগ করতে।
১৯৫২ সালে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর অভিপ্রায়ে এই বোর্ড তৈরি হয়েছিল পুপুল জয়কর এবং কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের দূরদর্শিতায়। এর বিলুপ্তি ঘটায় তাই বিস্মিত ‘দস্তকর’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চেয়ারপার্সন লায়লা ত্যাবজি। দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্থা কাজ করে চলেছে ভারতের কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজনদেরকে নিয়ে। সেই সংস্থার বর্তমান চেয়ারপার্সন রীতিমতো খেদ প্রকাশ করে জানিয়েছেন বহু ঝড় ঝাপটা পেরিয়েও কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্থা তাঁত সহ অন্যান্য কুটির শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং বহু মানুষের অভিজ্ঞতা এবং উপদেশকে সম্বল করে একটি কার্যকরী ‘ফোরাম’ গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল। সেই সদর্থক বিষয়গুলির অনুপস্থিতি ভারতীয় কুটির শিল্পের জন্য খুব আশাব্যঞ্জক খবর নয়।
আরও পড়ুন
দেশের ২২টি সরকারি ভাষাতেই প্রকাশিত করতে হবে সরকারি বিজ্ঞপ্তি, জানাল সুপ্রিমকোর্ট
১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু নিজে থেকে আগ্রহ দেখিয়ে জয়করের মতো ব্যক্তিত্বকে ডেকে এনে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে। জয়করের উদ্যোগে এবং কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই এই বোর্ড ছাড়াও গড়ে উঠেছিল ন্যাশনাল ক্র্যাফট মিউজিয়াম এবং সেন্ট্রাল কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ এম্পোরিয়া। পরবর্তীকালে ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী শরদ যাদবকে এর চেয়ারম্যান করে নতুন রূপ দেওয়া হয় এই বোর্ডকে। যদিও তখন থেকেই এই সংস্থার পতন শুরু বলে অভিযোগ।
দস্তকর সংস্থার হাট সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি জয়া জেটলির বক্তব্য, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু হওয়ার পর থেকেই বোর্ডের কাজকর্ম সন্দেহজনক হতে শুরু করে। কোনোরকম উন্নয়ন বা গঠনমূলক কাজ করতে পদে পদে বাধা পেতে হয় এই বোর্ডকে। কর্পোরেট এবং বড়লোক ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতেই বেশি চিন্তিত ছিল এই বোর্ড, যার ফলে গরীব শিল্পীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েই চলেছিল। তাই এই অবলুপ্তি ছিল সময়ের অপেক্ষা। বারবার এই বোর্ডের পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন সেই কথা জানানো হলেও কানে তোলা হয়নি কোনো পরামর্শ। প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইনের প্রাক্তন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অশোক চ্যাটার্জির কথাতেও। এখন সেই সুযোগ পুরোপুরিই চলে গেল বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।
আরও পড়ুন
চোখের দিকে তাকালেই নিশ্চিত অজ্ঞান; জাদুকর এসি সরকার-কে নিয়ে শোনা যেত এমনই
যদিও পাবলিক পলিসি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা ব্যক্তিত্ব নরসিংহ রেড্ডি নিজস্ব কলমে জানিয়েছেন, যেখানে হ্যান্ডলুম বোর্ডের পিছনে বছরে মাত্র লাখ খানেক টাকা খরচ, সেখানে ঠিক কোন যুক্তিতে খরচ কমিয়ে উন্নত পরিষেবা প্রদানের কথা বলা হল, তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। বিশেষ করে এই লকডাউন এবং তার পরবর্তী সময়ে যেখানে এই বোর্ড আরও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারত, তখন তাতে নতুন করে উৎসাহ না দিয়ে এর অবলুপ্তি বিস্ময়কর। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ তৈরি করার কথা বলা হলেও যেখানে কুটির শিল্পে বাজেট বরাদ্দ দিন দিন কমতির দিকে, সেখানে এই ধরনের সিদ্ধান্ত ‘হতবুদ্ধিকর’ বলে ধরা দিয়েছে রেড্ডির চোখে।
সুতরাং এক সমুদ্র বিপন্নতা নিয়েই বেঁচে থাকা তাঁতিদের কফিনে শেষ পেরেকটি মারতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার, তা নিয়ে আশঙ্কায় বহু বিশেষজ্ঞই। যেখানে প্রায় ৬৫ লক্ষ পরিবারের জীবন এর উপর দাঁড়িয়ে, সেখানে বিগত দিনগুলিতে কৃষক হত্যার মতো কুটির শিল্পীদেরও আত্মহত্যার খবর ঢাকা পড়ে গিয়েছিল মেকি উন্নয়নের ঘনঘটায়। ২০১৬-১৭ কেন্দ্রীয় বাজেটের তুলনায় ২০১৮-১৯ বাজেটে হ্যান্ডলুমের বরাদ্দ এক ধাক্কায় কমে দাঁড়িয়েছিল তিন ভাগের এক ভাগ। তার সঙ্গে মিলেছে আচমকা নোটবন্দি অথবা জিএসটির ধাক্কা। ফলাফল: ২০১৪ থেকে ২০১৭, তিন বছরে শুধুমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশেই ৬১৫ জন এবং বেনারসে ২০ জন তাঁতির আত্মহত্যা। আত্মহত্যার চেষ্টার খবর পাওয়া গিয়েছিল আরও অন্তত ১৫০০টি ক্ষেত্রে। সুতরাং আত্মনির্ভর ভারত কি আসলেই বৃহৎ পুঁজির দালাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমাদের খুঁজে পেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যদিও কুটির শিল্পীদের উন্নয়ন বা বেঁচে থাকার প্রতি সরকারের আদৌ কোনো দায় বা সদিচ্ছা থেকে থাকলে, তবেই!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor