একুশ শতকে দাঁড়িয়েও ভারতের অন্যতম একটি প্রচার মাধ্যম বেতার। যার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এবার বদল হতে চলেছে তারই। এয়ার অর্থাৎ অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে যে হিন্দি ছাড়া আর কোনো ভাষায় এবার থেকে আর প্রচার হবে না, তা জানিয়ে দিল প্রসার ভারতী। দিল্লির মূল সম্প্রচার কেন্দ্রে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হিন্দি ছাড়া অন্যান্য ভাষাগুলির ইউনিট। তা স্থানান্তরিত করে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজধানীগুলিতে।
২০১৬ সালে লোকসভায় প্রথম উঠেছিল এই প্রসঙ্গ। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল, মোট ১২টি ভাষায় আর কোনো সম্প্রচারণ হবে না দিল্লি থেকে। আঞ্চলিক সংবাদ ইউনিট থেকেই কেবলমাত্র সেসব ভাষার সম্প্রচারণ হবে। সেই তালিকায় অরুণাখালী, অহমিয়া, ডোগ্রি, মালায়ালাম, মারাঠি, ওড়িয়া, তামিলের পাশাপাশি ছিল বাংলাও।
আর তার কারণ হিসাবে বয়ানে কী বলেছিল কেন্দ্র? সাফ জানানো হয়েছিল এই সম্প্রচারণ ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’। সম্প্রচারণ মন্ত্রী বলেছিলেন, কোনো ভাষায় সম্প্রচারণ করার জন্য যে দক্ষ ইউনিটের প্রয়োজন পড়ে, হিন্দি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় তেমন কোনো কর্মীই নাকি পাওয়া যাচ্ছে না দিল্লিতে। হ্যাঁ, স্রেফ জনবল এবং প্রতিভার অপ্রতুলতা দেখিয়েই দায় সেরেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে সত্যিই কি বলার আছে কিছু?
একাধিক রাজনৈতিক দলের সাংসদ তো বটেই, প্রশ্ন তুলেছিল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও। তবে তাতে যে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি কেন্দ্র, প্রমাণ হয়ে গেল তা। ইতিমধ্যেই দিল্লি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি ভাষার ইউনিট। বর্তমানে সারা ভারতজুড়েই যেন চলছে বিভাজনমূলক রাজনীতি। আর তার থাবা থেকে নিস্তার পায়নি ভাষাও। ভাষাকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে আধিপত্যবাদী রাজনীতি। ইচ্ছেকৃতভাবেই মানুষের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে কোনো নির্দিষ্ট ভাষা।
আরও পড়ুন
মাত্র নয় বছর বয়সে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র শিল্পী হয়েছিলেন পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়
এই ঘটনাও কি তবে বৃহত্তর সেই প্রচেষ্টারই অঙ্গ? “আমাদের সংবিধানে কিন্তু প্রতিটা ভাষাকেই সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে কোথাও উল্লেখ নেই যে হিন্দি বা অন্য কোনো ভাষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গত মাসের ২১ তারিখেই ভাষা দিবস ছিল। আর মাতৃভাষা নিয়ে এতকিছু বলার ঠিক এক মাসের মধ্যেই এমন একটা আঘাত হানা হল এতগুলো ভাষার ওপরে। ভার্নাকুলার ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে লড়াইয়ের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তারপরেও যেন সেটাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। সংবিধান বলছে তোমার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু ভাষাতেই যদি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় একটা মানুষের, তাহলে আর কোথায় স্বাধীনতা?”, প্রশ্ন তুললেন ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজের মাস কমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপিকা দীপাঞ্জনা বসু মজুমদার।
আকাশবাণীর কণ্ঠশিল্পী সায়ন্তন ব্যানার্জির কথাতেও ফুটে উঠল সেই কথাই, “কোন ভাষায় সম্প্রচার করা যাবে আর কোন ভাষায় যাবে না— এটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত ছ’বছর ধরেই অন ইন্ডিয়া রেডিয়োর সমস্ত প্রোগ্রাম একটু একটু করে শিফট করছে হিন্দিতে। বেসরকারি রেডিও স্টেশনগুলো কোট-আনকোট একটা কর্পোরেট পলিসিতে চলে। তবে এখানে সরকার সেই কাজটা যেন করছে। অর্থাৎ, যে যুবক-যুবতীরা রেডিও জগতে আসতে চাইছেন, তাঁদের হিন্দিটাই জানতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।”
আরও পড়ুন
হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই; বাংলার দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলনেই জন্ম পুরুলিয়ার
কথার প্রসঙ্গেই তিনি মনে করিয়ে দিলেন ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই। ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে গণ্য করা হয়। তবে হিন্দি আধিপত্যের মাধ্যমে সরকারি ভাষার মর্যাকে হ্রাস করে যেন ‘আঞ্চলিক’ ভাষার তকমাই সেঁটে দেওয়া হচ্ছে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। কিন্তু এই কি প্রথম? এর আগেও ২০১৯ সালে আহমেদাবাদ, হায়দরাবাদ, শিলং, লখনউ এবং তিরুবনন্তপুরম— এই পাঁচ শহরে প্রচারও বন্ধ করে দিয়েছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও। কারণ হিসাবে তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রক দেখিয়েছিল, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলিতে নাকি একাবারেই লাভজনক হচ্ছে না ব্যবসা।
“আজ যদি এটা রেডিয়োর ক্ষেত্রে হয় তবে কাল শিক্ষা-চাকরি সমস্ত জায়গায় হিন্দি ভাষাটাকে চাপিয়ে দেওয়া হবে। সবথেকে বড়ো কথা, লকডাউনেও আমরা দেখেছি বেশিরভাগ ঘোষণা এবং বিজ্ঞাপন কিন্তু হিন্দিতেই হয়েছে”, ক্ষোভ উগড়ে দিলেন সায়ন্তন।
আরও পড়ুন
হিন্দি আগ্রাসন ও ভাষা-রাজনীতি : প্রশ্নের মুখে দেশের সম্প্রীতিও?
চলতি সময়ে বেতারের লাভ কমেছে অনেকটাই, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। গত তিন বছরে অর্ধেকে এসে ঠেকেছে প্রসার ভারতীর ব্যবসা। কিন্তু সেই কারণে একটি মাধ্যমকে মুছে ফেলা কি সত্যিই যুক্তিযুক্ত? টেলিভিশন, ডিজিটাল মিডিয়া এবং সর্বোপরি সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর বেতারের জনপ্রিয়তা যে কমেছে, তা ঠিকই। তবে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষেরা? “লকডাউনের সময় আমি গ্রামে গ্রামে কাজ করেছি। সামনে থেকে তাই দেখেছি, প্রান্তিক অঞ্চলের বাসিন্দাদের একটা বড়ো অংশ সম্পূর্ণ নির্ভর করে থাকেন শুধুমাত্র রেডিও-র ওপরেই। এবং তার থেকেও বড়ো কথা সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দৃষ্টিহীনরা। কারণ টিভি, স্মার্টফোন এলেও তাঁরা নির্ভরশীল রেডিয়োর ওপরেই”, বলছিলেন সায়ন্তন। এককথায়, দিল্লি থেকে শুধুমাত্র হিন্দির সম্প্রচারণ যেন এই ধরণের মানুষগুলোকেই বাধ্য করা হিন্দি ভাষা ব্যবহারে। কিন্তু প্রভাবশালী ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এই বৈষম্যমূলক রাজনীতির শেষ ঠিক কোথায়, তা জানা নেই কারোরই।
Powered by Froala Editor