মাইলের পর মাইল হেঁটে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় দলে দলে ঘরে ফিরছেন তাঁরা। তাঁরা ভিন রাজ্যে কাজ করা পরিযায়ী শ্রমিকের দল। ‘কেউ না’ থেকে আচমকা সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছিল তাঁদের অপারগতা, অসহায়তা এবং বাড়ি ফিরতে চাওয়ার আকুতি। শুধু তাই নয়, বাড়ি ফেরাও হয়নি তাঁদের অনেকের। কখনও পথশ্রমের ক্লান্তিতে, কখনও অসুস্থতায় পথেই প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। কখনও ক্লান্ত অবস্থায় রেললাইনের ওপরেই শরীর চিনে নিয়েছে ঘুম। মৃত্যুর চাকা গড়িয়ে আসার শব্দও সেই ঘুম ভাঙাতে পারেনি তাঁদের।
স্বাভাবিকভাবেই দেশে লকডাউন চলাকালীন পরিযায়ী শ্রমিকদের এই দুর্দশার ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল দেশের রাজনীতি। আশা করা হয়েছিল এই সকল শ্রমিকদের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নির্দিষ্ট কোনও সুরাহার কথা অবশ্যই ঘোষণা করা হবে সরকারের তরফে। দীর্ঘদিন পরে সংসদ চালু হওয়ার পরে আশা করা হয়েছিল নতুন কোনও প্রকল্পের দেখা মিললেও মিলতে পারে পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধার্থে। কিন্তু আশাই সার। ক্ষতিপূরণ তো অনেক দূরের কথা, পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনাই স্বীকার করা হল না কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে।
বাদল অধিবেশন শুরু হতেই সংসদ উত্তাল হয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তুলে। কিন্তু কেন্দ্র রীতিমতো জোর দিয়ে জানিয়ে দেয় যে, লকডাউনের সময় কোনও পরিযায়ী শ্রমিকদের নিহত অথবা আহত হওয়ার কোনও তথ্য বা নথি তাদের কাছে নেই। সেখানেই না থেমে তারপরেই কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের থেকে একপ্রকার বিবৃতি দিয়েই এই ঘটনার দায় ‘ফেক নিউজ’-এর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় যে, দেশের অন্যান্য সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করতে লকডাউনের সময় মিডিয়ায় যেভাবে 'ফেক নিউজ' ছড়ানো হয়েছিল, তাতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শ্রমিকেরা। তার ফলেই দুর্ঘটনা যা ঘটার ঘটেছে।
যেভাবে এই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, তা চমকে ওঠার মতোই। কারণ পরিযায়ী শ্রমিকদের যে দুর্দশার ছবি দিনের-পর-দিন উঠে এসেছিল টিভিতে সংবাদপত্রে কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে, সেই ঘটনা কিন্তু কয়েক বছর অথবা কয়েক দশক পুরোনো নয়। সদ্য কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা কারুর মন থেকেই মুছে যায়নি এখনও।
কিন্তু কেন সরকার এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা? কোনও সরকারি নথি নেই বলে কি শ্রমিকদের মৃত্যুর ব্যাপারটিও এক্ষেত্রে মিথ্যে হয়ে যায়? আর নথি রাখাই বা হল না কেন? শ্রম মন্ত্রকের বক্তব্য, কোভিড-১৯ সংকটের কারণে পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মহীনতা নিয়ে কোনও তথ্য রাখা যায়নি। যদিও তাঁদের আর্থিক সহায়তা, খাবারের প্যাকেট এবং অন্যান্য সুবিধাদি পৌঁছে দেওয়ার জন্য কেন্দ্র সরকার অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানানো হয় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। তবে বর্তমান আধুনিক মিডিয়ার যুগে তাতে লাভের লাভ কতটা হয়েছে তার প্রমাণ দেখা গিয়েছিল চোখের সামনেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রের বক্তব্য তাহলে কী? কেন্দ্রের কাছে নথি নেই, তার অর্থ কি এই যে, আসলে কেউ মারা যাননি?
গবেষক থেজেশ জিএন, কণিকা শর্মা, ক্রুষ্ণা এবং আমান 'রোডসস্কলারজ' নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় লকডাউনের ফলে মারা যাওয়া ভারতীয়দের একটি ডাটাবেস তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করেছিলেন। ৪ জুলাই অবধি, তাঁদের ডাটাবেস অনুযায়ী অনাহার, আর্থিক সঙ্কট, ক্লান্তি, অভিবাসনের সময় দুর্ঘটনা, চিকিত্সা ও যত্নের অভাব, আত্মহত্যা, পুলিশি বর্বরতা ইত্যাদি কারণে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৯৭১ জন।
আরও পড়ুন
লকডাউনে খাদের কিনারায় দলিত, মুসলিম এবং আদিবাসীরা, পৌঁছোয়নি ত্রাণও; প্রকাশ সমীক্ষায়
কিন্তু কেন বেসরকারি উদ্যোগে এই ডাটাবেস তৈরি করা প্রয়োজন দেখা দিল? গবেষক দলের বক্তব্য, অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তাকে ক্রমাগত অস্বীকার করে আসছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তাই সেই সময়ের বাস্তব ছবিটা তুলে ধরে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল পরবর্তী সময়ের জন্য।
অর্থাৎ, এই কথা পরিষ্কার যে, এই বছরের মার্চের শেষ পর্বে লকডাউন ঘোষণার সময় পরিকল্পনায় গলদ রয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রা শুরু করতে বাধ্য হওয়া জনগণের দুর্দশাগুলি উপেক্ষা করাও অন্যতম বড় ভুল। অভিবাসীদের এই সংকটকে তারপরেই একটি বিশাল মানবিক সংকট বলে অভিহিত করা হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। তাই সরকার যতই দরদ দেখানোর কথা বলুক না কেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফাটা পায়ের ছবিতেই বোধগম্য হয়ে যায় পুরো বিষয়টা।
সেভ লাইফ ফাউন্ডেশনের তথ্যে দেখা গিয়েছে লকডাউন চলাকালীন প্রায় ২০০ জন অভিবাসী শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। এই সকল শ্রমিকদের বেশিরভাগই ছিলেন উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, তেলঙ্গানা এবং মহারাষ্ট্র থেকে। এইসব মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটেছে লকডাউনের তৃতীয় পর্যায়ে। এছাড়াও সংবাদ সংস্থা হিন্দুস্থান টাইমসের তথ্যে উঠে এসেছে যাত্রী পরিবহনের শোচনীয় পরিস্থিতির কথাও। অসহ্য গরম এবং অভুক্ত থাকার ফলে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনগুলিতেও শ্রমিক মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটেছে। মে মাসের ৮ থেকে ২৭ তারিখ অবধি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনগুলিতে মারা গিয়েছেন গিয়েছেন প্রায় ৮০জন পরিযায়ী শ্রমিক।
আরও পড়ুন
১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?
অথচ সরকারের কাছে কোনও সংখ্যা নেই তার! কোনও সংখ্যা না থাকলে দায়ও থাকে না আর। তাই সহজেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় এইসব মৃত্যুর থেকে। কোনও ক্ষতিপূরণ নয়, কোনও অনুকম্পা নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্লজ্জ প্রতিক্রিয়া এবং তা সংসদের বুকে দাঁড়িয়েই, আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের দিনে গণতন্ত্রকে ঠাট্টাই করে গেল যেন এক রকম!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor