তখন বিশ্বযুদ্ধের সময়। ক্রমশ সীমান্তের পরিধি বাড়িয়ে চলেছে নাৎসি বাহিনী। জার্মানি অধিগ্রহণ করেছে নেদারল্যান্ডসকেও। হস্তক্ষেপ করেছে সে দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। তবে কি যুদ্ধের খবরাখবর পাওয়া যাবে না? একমাত্র বিকল্প তখন ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং স্টুডিও। বিবিসি-ই রেডিও অরেঞ্জের মাধ্যমে সম্প্রচারিত করত একটি ডাচ অনুষ্ঠান। কিন্তু যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে রেডিও কেনার মতো অর্থ কোথায়? কাজেই নিজেই রেডিও বানাতে উদ্যত হয়েছিলেন বছর আঠারোর এক যুবক। আর সফলও হয়েছিলেন তাতে। সেই রেডিয়োর মাধ্যমেই অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে সামান্য আলোর আশা দেখতেন পরিবারের সদস্যরা।
লু অটেন্স। সিডি-র কথা বললেই একবাক্যে তাঁকে চিনতে পারবেন যে কেউ। শুধুই কি সিডি? বরং পকেট টেপ রেকর্ডার কিংবা ওয়াকম্যানের সঙ্গেও বিশ্ববাসীর পরিচয় করিয়েছিলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। গত ১১ মার্চ ডুইসেলে নিজের বাড়িতে প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি ডাচ প্রযুক্তিবিদ। যাঁর হাত ধরেই বিপ্লব এসেছিল সঙ্গীতের জগতে।
১৯২৬ সালের ২১ জুন নেদারল্যান্ডসের বেলিংওল্ড শহরে জন্ম অটেন্সের। ছোটো থেকেই ছিল কারিগরি বিদ্যার প্রতি গভীর আকর্ষণ। বাড়ির বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র মাঝেমধ্যে খুলে ফেলে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন তিনি। তার ফলস্বরূপ কুড়ির কোঠা পেরনোর আগেই নিজস্ব কায়দায় তৈরি করে ফেলেন সম্পূর্ণ রেডিও। সে রেডিওতে ছিল একটি বিশেষ অ্যান্টেনার বন্দোবস্ত। যার মাধ্যমে ‘জার্মানেনফিল্টার’-খ্যাত জার্মান সেনাদের জ্যামার এড়িয়েও তরঙ্গ ধরা যেত ‘রেডিও অরেঞ্জ’-এর।
তবে প্রথাগতভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার পাঠ নেওয়া অনেকটা পরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ারও বছর দুয়েক পর হাতেখড়ি কলেজে। স্নাতকতা অর্জন করার পরেই অটেন্স যোগদান করেন ফিলিপস কোম্পানিতে। সেটা ১৯৫২ সালের কথা। পাঁচ বছরের মধ্যেই পদোন্নতি। সাধারণ প্রযুক্তিকর্মী থেকে সোজা পণ্যবিকাশ বিভাগের প্রধান। বেলজিয়ামের হ্যাসেল্ট শহরে তিনি বাস্তবায়নের কর্মসূচি নিলেন নিজের এক কাল্পনিক ব্যবস্থাপনার।
আরও পড়ুন
সাহিত্য অ্যাকাদেমি পাচ্ছেন শংকর
কাল্পনিক এই অর্থে কারণ গানের ক্যাসেট যে পকেটে করে নিয়ে ঘোরা যেতে পারে, তেমনটা তখনও পর্যন্ত ভাবনাতেও আনতে পারতেন না কেউ। দায়িত্বে আসার পর অপেক্ষা করতে হয়েছিল মাত্র ৩ বছর। ১৯৬০ সালে পৃথিবী প্রথম পরিচিত হল কমপ্যাক্ট ক্যাসেটের সঙ্গে। ১৯৬১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণের জন্য বাজারে প্রকাশ পেল সেই ক্যাসেট। নব্বই কিংবা শূন্য দশক অবধিও যার একছত্র বিরাজ ছিল বাজারে।
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই টেপ ক্যাসেটের মাধ্যমে সহজেই রেকর্ড করা যেত ঘরোয়া সঙ্গীত কিংবা অন্য কোনো কণ্ঠস্বর। ফলত বিভিন্ন মিউজিক কোম্পানির সঙ্গে সঙ্গে ‘ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট’-এর চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। জার্মানিতে সে সময় ফিলিপসের ঢালাও বিজ্ঞাপন দেখা যেত। ‘এক প্যাকেট সিগারেটের থেকেও ছোটো। পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ান পছন্দের গান।’
আরও পড়ুন
৯০-এ পা মিডিয়া-সম্রাটের, মার্ডকের বিপুল সাম্রাজ্যের পরিণতি কী?
সেই ক্যাসেটেরই কিছু প্রতিলিপি হাত ঘুরে পৌঁছেছিল জাপানে। অভিভূত হয়ে এগিয়ে আসে সোনি কোম্পানি। ফিলিপসের সঙ্গে সোনির সেই ঐতিহাসিক চুক্তিই অনেকটা দায়ী কমপ্যাক্ট ক্যাসেটের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার পিছনে। তবে থেমে থাকলেন না অটেন্স। বছর দুয়েকের মধ্যেই নতুন উদ্যমে আরও একবার চমক লাগালেন তিনি। এবার পোর্টেবল টেপ রেকর্ডার। তার আয়তনও পকেটের সাইজেরই।
এখানেই শেষ নয়। ১৯৭২ সালে ফিলিপস বাজারে আনে সঙ্গীত শ্রবণের আরও একটি নতুন মাধ্যম— সিডি। সেই উদ্ভাবনী পিছনেও রয়েছেন তিনি। তবে খানিক বিবর্তন হয়েছে তার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আজকে যে সিডি দেখতে অভ্যস্থ আমরা তা তৈরি হয়েছিল ১৯৮০ সালে ফিলিপস এবং সোনির যৌথ উদ্যোগে। তাছাড়া সোনির ওয়াকম্যান হ্যান্ডসফ্রি-র উদ্ভাবকদের মধ্যেও অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব অটেন্স।
আরও পড়ুন
প্রয়াত কিংবদন্তি বেহালাবাদক শিশিরকণা ধর চৌধুরী
তবে যত দিন গেছে সোনি, ফিলিপসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই সব যন্ত্রের অনুলিপি বানিয়েছে বহু বহু কোম্পানি। তা সত্ত্বেও অটেন্সের স্বত্বাধীন ক্যাসেট বিক্রি হয়েছিল বিশ্বব্যাপী ১০ হাজার কোটি কপি। সিডির ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ২০ হাজার কোটি। বিনয়ী অটেন্সের দাবি ছিল, গানের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিল এইসব অভিনব যন্ত্র।
তবে এত সাফল্যের পরও শেষ বয়সে হামেশাই তাঁর কথায় উঠে আসত অভিমানের সুর। সোনি ওয়াকম্যানকে যে চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেবে বাজারে, তা যেন কল্পনাতেও আনতে পারেননি কোনোদিন। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্যেও যেন মিশে থাকল সেই আক্ষেপ। আজকের প্রজন্ম স্মার্ট ফোন কিংবা কম্পিউটারে গান শুনতে অভ্যস্ত। তবে ভিনাইল থেকে এই বিবর্তন অটেন্সের ধারাবাহিক কিছু আবিষ্কার ছাড়া কখনোই সম্ভব হত না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি আদৌ জানতে পারবে সে-কথা?
Powered by Froala Editor