ভারতের রাস্তা-ঘাট, রেলস্টেশনে কিংবা বাসস্টপ— সর্বত্রই রাজত্ব কুকুর-বিড়ালের। অনেকে যেমন তাদের কোলে তুলে নেন সস্নেনে। তেমন আবার অনেকেই তাদের দেখে নাক সিঁটকে দূরে সরে যান ভয়ে কিংবা ঘৃণায়। কিন্তু এই একই পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় দূরপাল্লার ট্রেন, জাহাজ কিংবা বিমানের ক্ষেত্রে? তাহলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে গেলেও আশ্চর্যের থাকবে না কিছুই। তবে বিশ শতকেরও মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এটাই অত্যন্ত সাধারণ ছবি ছিল ইউরোপীয় পণ্যবাহী জাহাজের।
হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। জাহাজ-জুড়ে সে-সময় ঘুরে বেড়াত অজস্র বিড়াল (Cats)। তাদের যেমন ‘পোষ্য’ বলাও চলে না। আবার উদ্বাস্তু পথ-বিড়ালও নয় তারা। বিশেষ করে বলতে গেলে, জাহাজ ছিল তাদের কর্মক্ষেত্র। মোটা ‘মাইনে’ দিয়েই তাদেরকে জাহাজে নিয়োগ করতেন জাহাজের মালিকরা। কিন্তু কী কাজ করত এই বিড়ালরা? হঠাৎ করে জাহাজে তাদের প্রয়োজনই-বা পড়ল কেন?
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। ইউরোপের একাধিক দেশে প্রাদুর্ভাব দেখা যায় প্লেগের। তার নেপথ্যে ছিল মূলত ইঁদুর বা রোডেন্ট গোত্রীয় প্রাণীরা। নাবিকরা বুঝে গিয়েছিলেন, জাহাজের পরিবেশকে সুস্বাস্থ্যকর রাখতে গেলে নিশ্চিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ইঁদুরের সংখ্যা। একদিকে যেমন তারা বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগ ও ব্যাধির জন্য দায়ী, তেমনই জাহাজে মজুত রাখা খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য মূল্যবান পণ্য ও সামগ্রীর ধ্বংসের নেপথ্যেও থাকে ইঁদুররাই। কিন্তু আস্ত জাহাজকে তো বার বার খালি করে ইঁদুর তাড়ানো সম্ভব নয় মানুষের পক্ষে। ফাঁদ পেতেও যে একশো শতাংশ নির্মূল করা সম্ভব তাদের— এমনটাও নয়। তবে উপায়?
সমাধান হিসাবে তাই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই উঠে এসেছিল বিড়ালের নাম। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই তাই আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময় ইঁদুর নিধনের (Rat Killing) জন্য ব্যাপক হারে বিড়াল নিয়োগ করত ইউরোপের বিভিন্ন জাহাজের মালিকরা। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে সুযোগ পেত নাবিকদের পোষা বিড়ালরা। তাছাড়াও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতেও ‘চাকরি’ পেত বহু ফিলাইন। তাদের মালিকরা মোটা অঙ্কের টাকাও পেতেন পোষ্য বিড়ালকে বিদেশে কাজে পাঠানোর জন্য। অন্যদিকে বিড়ালদের জন্যও বিশেষ থাকা ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকত জাহাজের মধ্যে।
পরবর্তীতে জাহাজে কর্মরত বিড়ালদের সংখ্যা গণনা এবং হিসেব নির্ণয়ের জন্য ব্রিটেন-সহ ইউরোপের বিভিন্ন জাহাজ-কোম্পানিগুলি চালু করে বিশেষ পাসপোর্ট। যা জাহাজের যাত্রীদের পোষ্য বিড়ালের থেকে ‘কর্মী’ বিড়ালদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে সাহায্য করত। ছোট্ট পুস্তিকা আকারে ছাপা এই পাসপোর্টে লেখা থাকত বিড়ালের নাম, তাদের বিবরণ, কোথা থেকে কাজে এসেছে তারা। স্বাক্ষরের জায়গায় তাদের থাবার প্রিন্টও বসানো হত এই পাসপোর্ট।
যদিও এই পাসপোর্ট আন্তর্জাতিকভাবে আইনত স্বীকৃত হত না মানুষের মতো। অর্থাৎ, বিদেশের মাটিতে জাহাজ পৌঁছালে এই পাসপোর্টের ওপর ভর করে সে-দেশের মাটিতে নামতে পারত না বিড়ালরা। বরং যে-সকল বিড়াল নাবিকদের পোষা, তারাই কেবলমাত্র নাবিকের পোষ্য হিসাবে বাইরে যাওয়ার অনুমতি পেত। বাকিদের দিন কাটত জাহাজের ভেতরেই। তা-সত্ত্বেও সে-যুগের ফিলাইন পাসপোর্ট হয়ে উঠেছিল নাবিক ও বিড়ালদের মধ্যে আশ্চর্য এক বন্ধুত্বের প্রতীক।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে চলে আসা একাধিক প্রযুক্তি। ব্যাপার হারে ব্যবহার শুরু হয় রাসায়নিক রোডেন্ট কিলারের। ফলে, বিড়ালের প্রয়োজনীয়তাও কমতে শুরু করে ক্রমশ। পাশাপাশি জাহাজের মধ্যে বিলাসবহুল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ইউরোপের একাধিক দেশ বিড়াল, কুকুর-সহ অন্যান্য চতুষ্পদ প্রাণীর উপস্থিতিতেও প্রতিবন্ধকতা জারি করে। ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায় ‘ফিলাইন পাসপোর্ট’-এর গৌরব।
তবে মজার বিষয় হল, জাহাজে বিড়ালরা কাজ হারালেও, এরপরও ওয়াশিংটন, মস্কো, পিটার্সবার্গ-সহ বিশ্বের একাধিক উন্নত শহরের বিশেষ বিশেষ ভবনে ইঁদুর মারার কাজ চালিয়ে গেছে বিড়ালরা। এমনকি আজও সেন্ট পিটার্সবার্গের রয়্যাল প্যালেস এবং মিউজিয়ামের স্থায়ী বাসিন্দা প্রকাণ্ড এক বিড়ালবাহিনী। তাদের কাজও ইঁদুর ধরাই। তবে বলাই বাহুল্য, এইসব বিড়ালদের পাসপোর্ট বা সরকারি নথি নেই কোনো।
Powered by Froala Editor