সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে নদীর গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সার দেওয়া প্রকাণ্ড বেশ কয়েকটি বাড়ি। যার মধ্যে যেমন রয়েছে বারোক বিল্ডিং, উইন্টার প্যালেসের মতো রাজপ্রাসাদ, তেমনই রয়েছে হার্মিটেজ মিউজিয়াম (Hermitage Museum)। ১৭৬৪ সালে রুশ জার তথা সম্রাজ্ঞী প্রথম এলিজাবেথ নির্মাণ করেছিলেন এই প্রাসাদপ্রমাণ মিউজিয়াম। অবশ্য তখন ঠিক মিউজিয়াম ছিল না হার্মিটেজ। বরং, ব্যক্তিগত সংগ্রহের চিত্র ও অন্যান্য শিল্প সামগ্রী সংরক্ষণের জন্যই এই মিউজিয়াম তৈরি করেছিলেন এলিজাবেথ (Elizabeth I)।
জারের রাজত্ব শেষ হয়েছে বহুকাল আগেই। সময়ের আবহে তার দরজা খুলে গেছে সাধারণ মানুষের জন্যেও। তবে আড়াইশো বছর পেরিয়ে এসেও এতটুকু ভাটা পড়েনি এই মিউজিয়ামের স্থায়ী বাসিন্দাদের রাজকীয়তায়। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই? অবাক হওয়াই স্বভাবিক। মিউজিয়ামে স্থায়ী বাসিন্দা! তবে কি তাঁরা খোদ জারের বংশধর?
তাঁরা মানুষ নন। বরং, এই মিউজিয়ামের স্থায়ী বাসিন্দা এক দল মার্জার (Cats)। হ্যাঁ, জারের আমল থেকেই রাজকীয় ঢঙে এই মিউজিয়ামে বসবাস করে আসছে বেশ কিছু বিড়াল। আর সেই সুবাদেই হার্মিটেজ বিল্ডিং স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ক্যাট কোয়ার্টার নামে। কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ জারদের হঠাৎ এই মার্জার প্রেমের কারণ কী?
ফিরে যেতে হবে হার্মিটেজ মিউজিয়ামের একেবারে জন্মলগ্নে। সেটা আঠারো শতকের শেষের দিক। সেন্ট পিটার্সবার্গের হার্মিটেজ মিউজিয়ামে তখন কোনো শিল্পকর্ম রাখাই দায়। নেপথ্যে ইঁদুরের দৌরাত্ম্য। সেসময় বেশ কিছু ঐতিহাসিক শিল্পকর্মও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ইঁদুরের কর্মকাণ্ডে। বিষয় কিংবা ফাঁদ কোনো কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছিল না তাদের উৎপাত। শেষ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বার করেন খোদ রানি। ইঁদুরের উপদ্রব ঠেকাতে বিড়াল প্রতিপালনের প্রস্তাব দেন তিনি।
আরও পড়ুন
জ্যান্ত বিড়াল দিয়ে তৈরি টেলিফোন! চমকে দিয়েছিলেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী
আরও পড়ুন
মহাকাশে পাড়ি দেওয়া প্রথম বিড়াল ‘ফেলিসেট’, রয়ে গেল বিস্মৃতির অতলেই
কিন্তু দু’-একটি পোষ্য বিড়ালের পক্ষে প্রকাণ্ড এই মিউজিয়ামকে রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব, তা ভালোই বুঝেছিলেন এলিজাবেথ। তাই তাঁর নির্দেশেই কাজান শহর থেকে ধরে আনা হয় রাস্তার বিড়ালদের। সম্রাজ্ঞী প্রথম এলিজাবেথের সিদ্ধান্তে রাতারাতি বদলে গিয়েছিল অঞ্চলের পথ-মার্জারদের ভাগ্য। সব মিলিয়ে ৬৫টি বিড়াল আশ্রয় পেয়েছিল হার্মিটেজ মিউজিয়ামের বেসমেন্টে। আশ্চর্যের বিষয় হল, শেষ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেছিল এলিজাবেথের এই প্রকল্প। বিড়ালের উপস্থিতিতে রেশ পড়েছিল ইঁদুরের দৌরাত্ম্যে। তবে শুধু এলিজাবেথই নন, পরবর্তী জারেরাও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন হার্মিটেজ বিড়ালদের। রাশিয়ার শেষ সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট এই বিড়ালদের অভিহিত করেছিলেন ‘গার্ডিয়ান অফ দ্য গ্যালারি’ নামে।
আরও পড়ুন
বিড়াল মারা যাওয়ার দুঃখে চোখের ভ্রু কেটে ফেলতেন প্রাচীন মিশরীয়রা!
জারের শাসনকাল শেষ হওয়ার এক শতাব্দী পরেও আজ অব্যাহত সেই রীতি। বিশেষ করে সোভিয়েতের পতনের পর হার্মিটেজ মিউজিয়ামে বেড়েছে বিড়ালের সংখ্যাও। তৎকালীন সময়ে আর্থিক অনটনের জন্য, বহু মানুষই পোষ্য বিড়ালকে ছেড়ে দিয়েছিল রাস্তায়। তাদেরকেও হার্মিটেজ মিউজিয়ামে জায়গা করে দেয় রুশ সরকার। বর্তমানে এই মিউজিয়ামে বেড়ালের সংখ্যা প্রায় ১০০-র কাছাকাছি। তাদের জন্য রয়েছে আস্ত একটি হেঁশেলের ব্যবস্থা। রয়েছে ২৪ ঘণ্টা পশুচিকিৎসা পরিষেবাও। তাছাড়াও রাজকীয় এই বিড়ালদের দেখভালের জন্য একদল পরিচারিকার খরচও বহন করে চলেছে প্রশাসন ও মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ।
প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যটক ভিড় জমান হার্মিটেজ মিউজিয়ামে। তবে এই জাদুঘরে বিড়ালের রাজকীয় উপস্থিতির সম্পর্কে তাঁরা জানেন না অনেকেই। সম্প্রতি রুশ প্রশাসনের উদ্যোগে সাধারণ মানুষের জন্য খুলে গেল হার্মিটেজ মিউজিয়ামের এই ‘ক্যাট কোয়ার্টার’-এর দরজাও। পৃথিবীর বৃহত্তম মিউজিয়ামের এই বেসমেন্টই এবার সবথেকে আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে উঠতে চলেছে পর্যটকদের কাছে…
Powered by Froala Editor