“এখন চারপাশে যা হচ্ছে, রাজনীতিটা হাসির খোরাক ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ওকে দোষারোপ করছে, ও একে। অথচ সকলেই পাঁকে ডুকে রয়েছে। বিষয় হল, কোনো ঘটনা নিয়ে আর আলাদা করে হাসির খোরাক খুঁজতে হয় না। সেটাকে শুধু কার্টুনের মোড়কে উপস্থাপন করলেই হয়। এই বিষয়গুলোকে ডায়রেক্ট এনকাউন্টার করতে চাই না। বাধ্য হয়ে করতে হয় কখনো কখনো। তবে আমি সাধারণত রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ, সুকুমার— এঁদের রেফারেন্স নিয়েই দেখাতে চাই কতটা নেমে যাচ্ছে আমাদের মানসিকতা।”
বলছিলেন জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট শুভম ভট্টাচার্য ওরফে ভট্টবাবু। ‘ভট্টবাবুর পেজ’-এর সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছুই নেই। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই ফেসবুক পেজ। ধরে রেখেছে বাঙালির ‘কার্টুন কালচার’-এর ঐতিহ্য। তবে কার্টুন মানেই যে শুধু নির্মেদ মজা, তা কিন্তু একেবারেই নয়। এই শিল্প বার বার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের। ভট্টবাবুর শিল্পেও টের পাওয়া যায় সেটাই। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছত্রে ছত্রে প্রতিফলিত হয় তাঁর আঁকা কার্টুনগুলিতে।
যেমন, দেওয়ালে লেখা দলীয় কার্যালয়। সামনে বড়ো বড়ো হরফে ছাপা পোস্টার। ‘খুড়োর কল আর চশমা নিলেই প্রতিশ্রুতি পূরণ’। তবে এই পরিষেবার শর্ত একটাই— জমা রাখতে হবে মগজ। সেখানে নাম লেখাতে লম্বা লাইন দিয়েছেন ‘গ্রাহক’-রা। কেউ আবার পরিষেবা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন আনন্দে। দু’চোখে শুধুই ‘প্রতিশ্রুতি’ দেখছেন যে তাঁরা। নতুন করে আর বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই এই ছবির মানে? হ্যাঁ, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তো এমনটাই। আর সেই পরিস্থিতিই ব্যঙ্গের আকারে তুলে এনেছেন শুভম।
“কোথাও কোনো অসঙ্গতি দেখা দিলে শুধু কার্টুনিস্ট নয়, যে কোনো শিল্পীরই প্রয়োজন সেটার প্রতিবাদ করা। কার্টুন মানে কোনো কিছুকে ব্যঙ্গ করা। যখন পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, বা কুরুচিকর হয়ে উঠছে— তখন সেটার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা উচিত। সামাজিক হোক বা রাজনৈতিক কার্টুন সেই কাজটাই করে”, বলছিলেন শুভম।
২০১৮ সাল থেকে শুরু হয়েছিল ‘ভট্টবাবুর পেজ’-এর পথ চলা। কার্টুনকে বেছে নেওয়া তারও আগে। তবে তখনও পর্যন্ত নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকেই তিনি প্রকাশ করতেন সেসব ব্যঙ্গচিত্র। “ব্যক্তিগত প্রোফাইলে সমস্ত কাজগুলো মধ্যে গুছিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই পেজটা তৈরি করি তখন”, কথা প্রসঙ্গে বললেন শুভম। তবে অবাক করার বিষয়, নিজে কোথাও সেভাবে আঁকা শেখেননি তিনি। “ছোটো থেকে রামায়ণ মহাভারত দেখে ছবির প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল।” পরে বিভিন্ন কমিক্সের বই আর পত্রিকার কার্টুন দেখে দেখেই তিনি আয়ত্ত করেছেন এই শিল্পকলা। সবটা নিজে নিজেই। জানা গেল, বর্তমানে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগে পাঠ্যরত। সেইসঙ্গে সমানভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যঙ্গ-চর্চাও।
একটা সময়ে বাংলা কার্টুন আর সংবাদপত্র যেন সমার্থক ছিল। এমনকি এই শতাব্দীর প্রথম দশকেও। ছোট করে হলেও কোনো না কোনো ব্যঙ্গচিত্র দেখা যেত প্রতিটি সংবাদপত্রেই। থাকত অরণ্যদেবের অতি সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক কমিক্স। বর্তমানে সেই রীতিটা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে। আর সেই কারণেই কি বিকল্প হয়ে উঠছে ডিজিটাল আর্ট?
“এখনও উদয় দেবের কার্টুন আমি ফলো করি। কিন্তু আমাদের মতো যারা কার্টুনিস্ট তাঁরা তো আর সংবাদপত্রে উপস্থাপনের সুযোগ পাই না। সেক্ষেত্রে ফেসবুক আমাদের কাছে একটা বড়ো প্ল্যাটফর্ম। সংবাদপত্রে এখনও যে ভালো কার্টুন হয়, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু আগের থেকে অনেকটাই কমেছে তার পরিধি। আর ফেসবুক আমাদের সরাসরি কানেক্ট করে দিচ্ছে যেকোনো ঘটনার সঙ্গে। ফলে মানুষের মধ্যেও সেই প্রবণতাটা দেখা যাচ্ছে। তাঁরা আর কার্টুনের জন্য সংবাদপত্রের দিকে তাকিয়ে থাকছেন না”, মত শুভমের।
তবে একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই, বৃহত্তর সংবাদমাধ্যমগুলি এখন চলে এসেছে ডিজিটাল মিডিয়াতে। সেখানেও কি তারা খুব কিছু চর্চা করছে কার্টুনের? প্রশ্ন থেকে যায় এই জায়গাটাতেই। তবে একটা কার্টুনের প্রতি সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষের আকর্ষণ যে ক্রমশ কমছে, তা নিঃসন্দেহে। বা আরও ভালো করে বললে, সাধারণ মানুষের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে যে কোনো উপস্থাপনাকে গ্রহণ করার উদারপন্থী মানসিকতা। সাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে অন্যের কোনো যুক্তিকেই যে মন দিয়ে শুনতে আর আগ্রহী নই আমরা। কার্টুন তো বটেই, ফেসবুকে যে কোনো ব্যঙ্গাত্মক শিল্পে সাধারণের মন্তব্য দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে বিষয়টা।
শুভমের কথাতেও ফিরে ফিরে আসছিল সেই প্রসঙ্গই, “আজকের দিনে কার্টুন একটা ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। থ্রেট কমেন্ট দিন দিন বাড়তে থাকবে আরও। চারদিকে একটা ভয়ের পরিবেশ। অল্পতেই প্রত্যেকের ভাবাবেগে লেগে যাচ্ছে। এ এইটা কেন বলল, ও ওইভাবে কেন প্রশ্ন করল— শিল্পীদের হুমকি দেওয়া, জেলে পুরে দেওয়া এখন অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমনটাও বলা হয়েছে।”
শুভমের কথায় উঁকি দেয় আরেক আশঙ্কাও। সংবাদমাধ্যম থেকে কার্টুনের ক্রমশ অবলুপ্তির আরেকটি কারণ হয়তো ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রভাব। তবে সেই ঘাটতিটা পূরণ করছেন ‘ভট্টবাবু’ কিংবা ‘মালি’-র মতো ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্টিস্টরা। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা বা গান যে প্ল্যাটফর্মটা পেয়েছে, সেখানে কার্টুনের অবস্থান ঠিক কোথায়? তার ভবিষ্যৎই বা কী?
“ফেসবুক নিজেদের মতামত বা শিল্পটাকে প্রকাশ করার জায়গা তো করে দিয়েছে। কিন্তু বিষয় হল সেটা কতটা মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তুলে দিতে পারছে? যে কোনো শিল্পের ক্ষেত্রেই যে শিল্পটা সৃষ্টি করছে আর যে ধারণ করছে— তাদের একটা গোষ্ঠীর দরকার হয়। আমার মনে হয়, সেই গোষ্ঠীটা না তৈরি হলে এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট কার্টুনটাও হারিয়ে যাবে”, বলছিলেন শুভম।
এই রাজনৈতিক তরজা ছাড়িয়ে আসা যাক অন্য একটি প্রসঙ্গে। কার্টুনের পাশাপাশি বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার নিকটতম আত্মীয় ‘কমিক্স’। একজন কার্টুনিস্ট হয়ে এই বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে পারলেন না ভট্টবাবুও, “কার্টুন আর কমিক্সের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। তবে বিদেশে একটা কমিক্সে যে ধরণের উপার্জন হয়, বাংলায় সেই সুযোগ নেই। আর সবাই তো নারায়ণ দেবনাথ নয়। ভালো কোনো কমিক্সের কাজ করতে গেলে, একজনের পক্ষে সেটা চাপ হয়ে যায়। সেটা সময়সাপেক্ষ যেমন, তেমনই স্ক্রিপ্টের দিকেও নজর রাখতে হয়। কিন্তু বাংলায় কমিক্স করায় উৎসাহী মানুষ রয়েছে। প্রচুর সাহিত্যও আছে, যাদের কমিক্সের রূপ দেওয়া সম্ভব। তবে একেবারেই এই জায়গাটায় কাজ হচ্ছে না বর্তমানে।”
সব মিলিয়ে কার্টুন হোক কি কমিক্স, প্রকাশকদেরই যে এগিয়ে আসতে হবে এই ক্ষেত্রটাকে নতুন করে অনুসন্ধান করতে। তবে ভট্টবাবুর থেকে কি আগামীতে কমিক্স পেতে চলেছে দর্শকরা? সামলানো গেল না এই প্রশ্ন করার লোভ। “তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই এখনও”, হেসে জানালেন শিল্পী। তবে ধারাবাহিকভাবেই আসতে থাকবে কার্টুন, সেই আশ্বাসও দিলেন শুভম। একটা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার দায় শিল্পীর পাশাপাশি তার দর্শক-শ্রোতাদেরও। সেখানে দাঁড়িয়ে, সংস্কৃতির মৃত্যু নিয়ে ‘হায় হায়’ না করে প্রত্যেককে সহনশীল হওয়ার অভ্যেস করতে হবে আমাদেরও। তা না হলে কোথাও গিয়ে গতিপথ হারিয়ে ফেলবে এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবও…
Powered by Froala Editor