আত্মপ্রকাশ সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে; প্রয়াত কার্টুনিস্ট ও পরিচালক গৌতম বেনেগাল

আশির দশকের একাবারে শুরুর দিক সেটা। সন্দেশ পত্রিকার জন্য এক তরুণ প্রতিভাবে আবিষ্কার করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। মাত্র ১৬ বছরের সেই কিশোর সাংস্কৃতিক জগতে যাত্রা শুরু করলেন সন্দেশের পাতায় বিচিন্ন ছবি আর কার্টুন এঁকে। তারপর ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকল তাঁর লেখা বিভিন্ন প্রতিবেদন, সাহিত্যরচনা। যা রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় পাঠকমহলে।

সেদিন ‘সন্দেশ’-এর সেই কিশোর শিল্পী আর কেউ নন, গৌতম বেনেগাল। না, প্রতিভা চিনতে কোনো ভুল করেননি সত্যজিৎ। অক্ষরে অক্ষরেই মিলে গিয়েছিল তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী। অচিরেই সেই কিশোর হয়ে উঠেছিলেন ভারতের প্রথম সারির একজন চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট, পরিচালক এবং সাংবাদিক। গতকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবেই প্রাণ হারালেন বর্তমান সময়ের অন্যতম তারকা গৌতম বেনেগাল। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর।

১৯৬৫ সালে কলকাতাতে জন্ম গৌতম বেনেগালের। একদম কিশোরবেলাতেই তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল চিত্রশিল্পে। পরবর্তীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতকতা করেন তিনি। তবে স্বপ্নের পিছনে অনুধাবন থেমে থাকেনি। কলেজে পড়াকালীন সময়েই নিজের শৈল্পিক দক্ষতাকে আরও জোরদার করতে অ্যানিমেশনে ডিপ্লোমার কোর্সে ভর্তি হন বেনেগাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিসাইনে সমান ভাবেই পাঠ নিয়েছেন সেসময়। অবশ্য ততদিনে সংস্কৃতিজগতে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছেন তিনি। সন্দেশ তো বটেই, পাশাপাশি একাধিক প্রথম সারির পত্রিকাতে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর লেখালিখি, ছবি, কার্টুন। 

পরবর্তীতে অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারের সুযোগ থাকলেও তিনি পেশাগতভাবে বেছে নেন সৃজনশীলতাকেই। অ্যানিমেশনকে হাতিয়ার করেই একাধিক চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন বেনেগাল। তাঁর তৈরি ‘কেলভিনেটর পেঙ্গুইন’ কিংবা ‘হ্যান্ডিপ্লাস্ট বয়’-এর মতো অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র সকলের কাছেই পরিচিত। ২০১০ সালে অ্যানিমেশন মুভি ‘দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য কাউন অফ স্টোন’-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার পান গৌতম বেনেগাল। কাইরো, তেহেরান, বার্লিন, টরোন্টোর মতো একাধিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নিয়েছিল তাঁর তৈরি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। ব্যক্তিগত ছবির পরিচালনা ছাড়াও ফিল্ম ডিভিশন অফ ইন্ডিয়ার জন্যও চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন বেনেগাল।

আরও পড়ুন
কান্দাহারে নিহত পুলিৎজার-জয়ী ভারতীয় চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি

সিনেমা তৈরির পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন একাধিক কিশোর সাহিত্য। ২০১১ সালে প্রকাশিত ছোটোগল্পের সংকলন ‘১/৭ বন্ডেল রোড’ রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা ভারতে। আন্তর্জাতিক সাহিত্যমঞ্চেও চর্চিত হয়েছিল তাঁর এই গ্রন্থ। শুধু গল্পই নয়, বরং গোটা বইটিতে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর আঁকা অজস্র ছবি। চলতি শতকে এহেন কিশোর সাহিত্যের উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায়। বলতে গেলে সত্যজিতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন বেনেগাল।

আরও পড়ুন
প্রয়াত তিনবারের জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী সুরেখা সিক্রি

সাম্প্রতিক সময়ে ডিএনএ, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার মতো সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছেন তিনি। বার বার তাঁর আঁকা কার্টুনে প্রতিফলিত হয়েছে বর্তমান সমাজের প্রতিচ্ছবি। সেসব কার্টুনই যেন নীরবে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। 

আরও পড়ুন
চার-চারবার বজ্রপাত শরীরে, রেহাই পাননি মৃত্যুর পরেও!

গত পরশুও কেন্দ্রের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল সম্পর্কে নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে শ্লেষাত্মক টুইট করেন প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট। তখন কে-ই বা জানত, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হঠাৎ করেই চিরকালের মতো থেমে যাবে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর! তাঁর এই প্রয়াণ-সংবাদ এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না ভারতের শিল্পীমহল। আসলে শিল্পীর যে মৃত্যু হয় না কোনো…

Powered by Froala Editor

Latest News See More