কলকাতার দিকে দিকে তখন বিক্ষোভ, বিদ্রোহ। বড়লাট লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে বাংলা। বাংলা এক, বাংলা অভিন্ন— কিছুতেই আলাদা করা যাবে না। হাতে হাত মিলিয়ে অনেকেই নেমেছিলেন রাস্তায়। সেইসঙ্গে পুলিশেরও ধরপাকড়, অভিযান শুরু হয়ে যায়। সেইসময়ই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এক সদস্যের কার্টুন আঁকা শুরু। ব্যঙ্গচিত্র যে আড়ালে আবডালে সরকারের বিরুদ্ধেই কথা বলে। আর এমন পরিস্থিতিতে এইসব আরও বেশি ‘উস্কানি’ দেবে। পুলিশ হাজির ঠাকুরবাড়িতে। কার্টুন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সব কার্টুন। স্বদেশিদের সঙ্গে হাত মেলানোর হদিশ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার। কিন্তু সেরকম কিছুই পেল না ব্রিটিশরা। ব্যাজার মুখে চলে গেল তারা। আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেসব দেখে কার্টুন এঁকে চলেছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর!
১৯১০ থেকে ১৯২০— এই দশ বছরে নিজেকে এবং নিজের সৃষ্ট কার্টুনকে মেলে ধরেছিলেন এক অন্য পর্যায়ে। এখানে তাঁর অস্ত্র ব্যঙ্গ। সমাজ আর প্রশাসনের দিকে তীব্রভাবে আঙুল তোলা এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের রাস্তা হিসেবে কার্টুনই ছিল তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। যেমন ধরা যাক ‘বিদ্যার কারখানা’ কার্টুনটির কথা। বড়ো একটি গেট দিয়ে ছেলেপিলেরা বই নিয়ে ঢুকছে। গেটের ওপরে একটি ঘড়ি। চারিদিকে কারখানার চিমনি; আর সামনে দুটো মোটা মোটা বই। ছাত্ররা যাচ্ছে, আর বইয়ের ভেতর দিয়ে পিষে বেরিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো প্রাণ যেন নেই আর শরীরে। সেই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার গালে যেন একটা চড় কষালেন গগন ঠাকুর। দেওয়াল ভাঙার গান, চার দেওয়ালে আটকে না থেকে প্রকৃতির বুকে খুঁজে নেওয়া নিজের পাঠ— এসবই তো আসল! কিন্তু সমাজ তো তা মানবে না! অতএব এভাবেই বইয়ের ভেতর দিয়ে পিষে নিয়ে যাবে শরীর…
শুধু এই কার্টুনই নয়। ‘বিরূপ বজ্র’, ‘নব হুল্লোড়’, ‘অদ্ভুত লোক’ ইত্যাদি নানা কার্টুন এই সনয় এঁকেছেন তিনি। তাঁর অন্যান্য ছবির প্রকাশভঙ্গি থেকে সরে গিয়ে এখানে যেন তিনি এবং তাঁর তুলি শক্তিশালী। সমাজের সমস্ত কালো দিক, সমস্ত অন্যায়, রাজনৈতিক গোলযোগ— সমস্ত কিছুকে হাতিয়ার করতেন তিনি। এর আগে এত ব্যাপক পরিমাণে কার্টুনকে কোনো বাঙালি শিল্পী ব্যবহার করেছিলেন কিনা জানা নেই। কিন্তু গগনেন্দ্রনাথের এই সৃষ্টি দ্রুতই সবার সমাদর পেল। শুধু তাই নয়, বিংশ শতকে কেবল ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের জন্য একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল; যা তখনকার দিনে প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল।
আরও পড়ুন
নিজস্ব ‘জাতীয় সঙ্গীত’ ছিল ভারতের এই অঙ্গরাজ্যের; সুরে-সুরে জড়িয়ে রবীন্দ্রনাথও!
এখনকার দিনের ভারত ধর্ম, জাতপাত নিয়ে মেতে উঠেছে। ধর্মের নামে মানুষও খুন হচ্ছে; জাতের ভেদাভেদের জন্য পড়ুয়াও গলায় ফাঁস দিচ্ছে। চলহে দাঙ্গা, পাল্টা মার, হুঁশিয়ারির পর্ব। কিন্তু আসল সমস্যার দিকে কোনো নজরই নেই! তবে এসব যে শুধু আজকে, তা তো নয়। ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদ নানা সময় প্রভাব ফেলেছে। ‘মিলস্টোন অফ কাস্ট’ ছবিতে গগন ঠাকুর দেখাচ্ছেন, ব্রাহ্মণ ওপরে বসে চাকটি ঘোরাচ্ছে, আর তার নিচে পিষ্ট হচ্ছে কিছু মানুষ। তাঁরা সব নিম্নবর্গের। জাতপাত নিয়ে এই ছবি কি খুব পুরনো হয়ে গেছে? আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে জাত, ধর্ম সব কিছুর ছবি যেন তখনই তুলে দিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির এই কৃতি সন্তান। সেইসঙ্গে রয়েছে পণপ্রথা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নিজের লেখায় এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সেই একই পন্থা নিয়েছেন গগনেন্দ্রনাথও। ‘কন্যাঘাতী বিয়ের কথাই ধরা যাক’…
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথকে 'নিষিদ্ধ' বই উৎসর্গ বিপ্লবীর; কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল বিশ্বকবিকেও
ছবিও কখনও কলমের চেয়েও তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। বন্দুকের নলের চেয়েও বেশি গর্জে ওঠে। গগনেন্দ্রনাথের অন্যান্য শিল্পকর্মের সঙ্গে ব্যঙ্গচিত্রকেও কি অস্বীকার করতে পারি আমরা? মাত্র দশ বছর, এই সময়তেই একটা নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন। নতুনভাবে নিজেকে সামনে এনেছিলেন। আসলে গগনেন্দ্রনাথের পরিবারেরই তো একজন লিখেছিলেন ‘অচলায়তন’-এর পাঁচিল ভেঙে দেওয়ার কথা।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হানা দিল পুলিশ