কলকাতায় প্রথমবার কার্টুন মেলা, রেবতীভূষণের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা বাংলার কার্টুনিস্টদের

আমোদপ্রিয় বাঙালির জীবন মেলা ছাড়া অসম্পূর্ণ। দুর্গা পুজো থেকে শুরু করে চড়ক— বারো মাসে তেরো পার্বন তো বটেই, তাছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প ও অন্যান্য শিল্পকে কেন্দ্র করে মেলা আয়োজনের চল বেড়েছে গোটা বাংলায়। তবে কার্টুনই বা বাদ থাকে কেন? এবার কলকাতার বুকে প্রথমবারের জন্য আয়োজিত হল এমনই অভিনব এক মেলা (Cartoon Mela)। যার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কার্টুনের ছাপ। বাংলা তো বটেই, কার্টুনকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ একটি মেলা সমগ্র ভারতে এই প্রথম।

ভারতবর্ষে কার্টুনের ইতিহাসকে খুঁজতে গেলে থিতু হতে হবে এই বাংলাতেই। আজ থেকে ঠিক দেড়শো বছর আগে বাংলার বুকেই আঁকা হয়েছিল প্রথম ভারতীয় কার্টুন। সেই সূত্রে উঠে আসতে বাধ্য রেবতীভূষণ ঘোষের (Rebati Bhushan Ghosh) নাম। চিত্রকর, ক্যালিগ্রাফার, কবি রেবতীভূষণকে বাংলা তথা ভারতের কার্টুন শিল্পের কাণ্ডারি বললে ভুল হবে না। শুধু কলকাতা নয়, দিল্লিতে থেকেও একাধিক পত্রপত্রিয়ায় ধারাবাহিকভাবে কার্টুন এবং লিমেরিককে তুলে ধরেছিলেন রেবতীভূষণ। তাঁর জন্মশতবর্ষে এবার মেলা আয়োজন করে অভিনব শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাল বাংলার কার্টুনিস্টদের সংগঠন ‘কার্টুন দল’। 

রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর লেকমলের নিকটবর্তী ‘রিড বেঙ্গলি বুক স্টোর’-এ বসেছে এই অভিনব মেলার আসর। কী নেই সেখানে? কার্টুনের বই থেকে শুরু করে নোটবুক; কার্টুন আঁকা টিশার্টি থেকে রেফ্রিজারেটর ম্যাগনেট, পোস্টকার্ড, ক্যালেন্ডার, ব্যাগ, পেপারওয়েট কিংবা কফি মাগ— দৈনন্দিন ব্যবহারের বিভিন্ন সামগ্রী। রয়েছে অরিজিনাল আর্টওয়ার্কেরও বিপুল সম্ভাব। বাংলার প্রথম কার্টুন মেলা আক্ষরিক অর্থেই যেন সব পাই-এর দুনিয়া। 

বিগত ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে এই মেলা। চলবে এক মাস, অর্থাৎ আগামী ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। “অনেকেই প্রান্তিক অঞ্চল বা মফঃস্বল থেকে মেলায় আসেন। তাঁদের কথা মাথায় রেখে এবং কোভিড প্রোটোকল মেনেই এক মাস ধরে এই মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত”, বলছিলেন অন্যতম বাঙালি কার্টুনিস্ট ও কার্টুন মেলার আয়োজক উদয় দেব। কিন্তু হঠাৎ এই ধরনের ভিন্ন স্বাদের মেলা আয়োজনের কারণ কী? তার পরিকল্পনাই বা হল কীভাবে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সাত বছর। সেটা ২০১৪ সাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক তথা বাংলা কার্টুন গবেষক শুভেন্দু দাশগুপ্তের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ‘কার্টুন দল’-এর পথচলা। রাজ্য চারুকলা মেলায় নিছকই পোস্টারের একটি স্টলে জন্ম হয়েছিল ‘কার্টুন দল’-এর। সেদিনের সেই স্টলে শুভেন্দুবাবুর সঙ্গী ছিলেন আরেক কিংবদন্তি শিল্পী হিরণ মিত্রও। জন্মলগ্নে সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র সাত জন। সেই তালিকায় ছিলেন দেবাশিস দেব, চণ্ডী লাহিড়ী, অমল চক্রবর্তী, অনুপ রায়, উদয় দেব, ঋতুপর্ণ বসু এবং উপল সেনগুপ্ত। “যাঁরা কার্টুন আঁকতে ভালোবাসেন, তাঁরা ক্রমশ যোগ দিতে থাকেন আমাদের দলে। তাঁদের কেউ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আবার চিকিৎসক কিংবা আইপিএস অফিসার”, বলছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তথা কার্টুন মেলার আয়োজক ঋতুপর্ণ বসু। পেশা ভিন্ন, নেশা এক— এই কার্টুনপ্রেমীদের সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে আজ দলের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় কুড়ি জনে। বর্তমানে শুভেন্দু দাশগুপ্তের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল আর্কাইভ। যে ওয়েবসাইটের দৌলতে আজ পাঠকের হাতের মুঠোয় বাংলা কার্টুন এবং বাঙালি কার্টুনিস্টদের ইতিহাস। 

বাংলার এই কার্টুনিস্ট সংগঠনই সর্বপ্রথম খবরের কাগজের পাতা থেকে কার্টুনকে তুলে এনেছিল গ্যালারিতে। মায়া আর্টসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আয়োজন করেছিল কার্টুন প্রদর্শনীর। সেই উদ্যোগ সফল হওয়ার পরই শুরু হয় কার্টুন ফেস্টিভাল আয়োজনের চিন্তাভাবনা। উদয় দেবের কথায়, “মুম্বাইতে কালা ঘোড়া ফেস্টিভাল কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমিক কনের মতো উৎসবগুলি বিপুল জনপ্রিয়তা পেলেও বাংলায় এই ধরনের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয় না। সেখান থেকেই কার্টুন মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা করি আমরা।” সাহায্যের জন্য সেসময় এগিয়ে এসেছিল রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের রিড বেঙ্গলি বুকস্টোর। 

কার্টুনকে সাধারণ মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলতেই এই প্রচেষ্টা। আর এই উদ্যোগ যে একশো শতাংশ সফল— তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে শুধু কলকাতা নয়, কার্টুনের এই মাদকতা গোটা বাংলাতেই ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ‘কার্টুন দল’-এর। সেই লক্ষ্য নিয়েই আগামী বছর এই মেলা আয়োজিত হবে বর্ধমানে। প্রতিবছর বদলাবে তার স্থান। “প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষরা শিল্পের প্রতি আগ্রহী হলেও, সেই সুযোগ পান না তাঁরা। তাই এক বছর শহরে ও পরের বছর মফস্বলে এই মেলা আয়োজনের কথা ভেবে আমরা”, জানালেন ঋতুপর্ণ বসু। এর আগে বিভিন্ন দেওয়াল এবং গাড়ির গায়ে কার্টুন এঁকে নজর কেড়েছিলেন কলকাতার কার্টুনিস্টরা। তাছাড়া কার্টুনের একাধিক কর্মশালারও আয়োজন করেছিল কার্টুন দল। এবার আরও একবার তাঁদের উদ্যোগ নিখাদ বিনোদন এবং স্বতন্ত্র চিন্তার জ্বালানি যোগাল বাঙালিকে। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More