জলবায়ু সংকট (Climate Crisis) নিয়ে বর্তমানে চিন্তিত গোটা বিশ্বই। তবে আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে সবুজতর পৃথিবী নির্মাণের জন্য একাধিক সিদ্ধান্ত নিলেও, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে সামান্যই। এই ঘটনার জন্য ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদকেই (Capitalism) কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন জাপানি লেখক, দার্শনিক, অধ্যাপক ও গবেষক কোহেই সাইতো (Kohei Saito)। স্পষ্টতই তাঁর দাবি, সীমাহীন মুনাফার জন্য ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পৃথিবীকে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস। প্রকাশিত হয়েছিল কোহেই সাইতোর লেখা বই ‘ক্যাপিটাল ইন দ্যা অ্যান্থ্রোপোসিন’। মহামারী ততদিনে থাবা বসিয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে। স্বাভাবিকভাবেই মহামারীর প্রভাবও প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর লেখায়। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই জাপানে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় এই গ্রন্থ। ২০২০ সালেই বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৫ লক্ষাধিক কপি। এবার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসের সৌজন্যে প্রকাশ পেতে চলেছে গ্রন্থটির ইংরাজি সংস্করণ। আর তা নিয়েই নতুন করে চর্চায় উঠে এসেছে ‘ক্যাপিটাল ইন দ্যা অ্যান্থ্রোপোসিন’।
মূলত মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষিতেই জলবায়ু পরিবর্তনকে দেখেছেন জাপানের শিক্ষাবিদ ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইতো। তাঁর মতে, পুঁজিবাদের কারণে সমাজের একাংশের হাতেই রয়েছে বিশ্বের মোট সম্পত্তির ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ, বৈশ্বিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক তাঁরাই। উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারে পণ্য উপলব্ধির সম্ভাবনা সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয় তাঁদের মাধ্যমে। ফলে, তাঁদের বিলাসবহুল জীবনই কোটি কোটি মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে দারিদ্র সীমার নিচে। বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনযাপনের ধরনও। ‘আনহাইজিনিক’ এই জীবনযাত্রা একদিকে যেমন বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তেমনই প্রভাবিত করছে জলবায়ু এবং দূষণকেও। উল্টোদিকে বিত্তশালীদের বিলাসবহুল জীবনযাপনে নষ্ট হচ্ছে খাদ্য, বাসস্থানের মতো জীবনধারণের রসদ।
এই বৈষম্যের ব্যবধান সংকীর্ণ না হলে, জলবায়ু পরিবর্তনকে বাগে আনা কোনোভাবেই সম্ভব নয় মানুষের। এক্ষেত্রে কার্ল মার্ক্সের তত্ত্বকেই অনুসরণ করছেন জাপানি গবেষক। প্রাকৃতিক সম্পদের সমবণ্টনই সার্বিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন আনতে পারে বলে বিশ্বাস তাঁর। আর তেমনটা হলে, প্রতিক্ষেত্রেই কমবে অপচয়। কম উৎপাদনেও চাহিদা মিটবে গোটা বিশ্বের। উল্টোদিকে রক্ষা পাবে পরিবেশও। কিন্তু একদিনে কি আদৌ সেই পরিবর্তন সম্ভব?
হ্যাঁ, সাইতোর ভাষায় তা সম্ভব। মহামারীই তা সম্ভব করে দেখিয়েছে। মহামারীর সময় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু কলকারখানা। তবে সম্পূর্ণভাবে থেমে থাকেনি পৃথিবী। বাড়িতে থেকেই কাজ চালিয়ে গেছেন বহু মানুষ। সেইসঙ্গে কমেছে যানবাহনের ব্যবহার। তাতে পরিবেশ যে সাময়িকভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিল, তাও প্রমাণিত হয়েছে একাধিক গবেষণায়। এই আকস্মিক পরিবর্তনই দেখিয়েছে মানুষের সামগ্রিক জীবনে বদল আনা সম্ভব। মোট কাজের সময়সীমা কমিয়ে কর্মীদের কর্মক্ষমতা বাড়ানোয় জোর দিলেই অনেকাংশে কমে আসবে দূষণ। কমবে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ। এমনকি অন্নসংস্থান হবে বহু মানুষের, যাঁরা কাজ হারিয়েছেন মহামারীর সময়ে। বলতে গেলে মার্ক্সবাদকে হাতিয়ার করেই আগামীদিনের টেকসই পৃথিবীর রূপরেখা এঁকেছেন সাইতো। সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেলেও, তাঁর এই তত্ত্বকে আদৌ কি মান্যতা দেবেন রাষ্ট্রনেতারা? সেই প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যাচ্ছে…
Powered by Froala Editor