দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণে অবস্থিত কেপ উপদ্বীপ। এই উপদ্বীপের উপকূল ধরে হাঁটতে থাকলেই দেখা মিলবে এক আশ্চর্য সৌধের। সাদা চুনাপাথরের তৈরি কয়েক ফুট উঁচু পাথরের দেওয়ালে বসানো রয়েছে সবুজ হয়ে যাওয়া তাম্রফলক। সেখানে ইংরাজি ও পর্তুগিজ ভাষায় লেখা ‘ইউ আর নাউ অ্যাট দ্য সাউদার্ন-মোস্ট টিপ অফ দ্য কনটিনেন্ট অফ আফ্রিকা’। দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa) তো বটেই, এই বিন্দু গোটা আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণতম বিন্দু, তাতে সন্দেহ নেই কোনো।
‘কেপ আগুলহাস’ (Cape Agulhas)। দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দুটি পরিচিত এই নামেই। তবে শুধু দক্ষিণতম বিন্দু হিসাবেই নয়, কেপ আগুলহাসের অবস্থানগত মাহাত্ম্যও কম নয়। একটু নজর দিলেই চোখে পড়বে, মূল সৌধটি থেকে খানিক দূরে, দু-দিকে বসানো রয়েছে দুটি তুলনামূলক ছোটো আকৃতির পাথরফলক। একটিতে লেখা ‘ইন্ডিয়ান ওসান’, অন্যটিতে ‘আটলান্টিক’। হ্যাঁ, এই বিন্দুতেই এসে মিলিত হয় ভারত ও আটলান্টিক— দুই মহাসাগর।
১৪৮৮ সাল। সমুদ্রের মাধ্যমে ভারতে পৌঁছানোর পথ খুঁজে বার করার জন্য দক্ষিণে পাড়ি দেন পর্তুগিজ অভিযাত্রী বার্তলোমিউ ডায়াস। ইউরোপ থেকে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর দক্ষিণে যেতে যেতে পৌঁছে যান এই বিশেষ অঞ্চলে। সেখানে উপদ্বীপীয় অঞ্চলের মাটি ক্ষয়ে তৈরি হয়েছে অর্ধবৃত্তাকার একটি উপসাগর। যার জল আক্ষরিকভাবে উজ্জ্বল আকাশী বর্ণের হলেও, উপকূল থেকে কয়েক মাইল গভীরে গেলেই বদলে যায় তার রং। হয়ে ওঠে সবুজাভ নীল। আজ এই বিশেষ উপসাগরটি পরিচিত ‘ফলস বে’ নামে। সমুদ্রের উত্তাল চরিত্রের কারণে তিনি এই অঞ্চলের নাম রেখেছিলেন ‘কেপ অফ স্টর্মস’। এমনকি তাঁর কথা মতো এটাই ছিল আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দু। তবে প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকার দক্ষিণতম অঞ্চল ‘কেপ আগুলহাস’ অবস্থিত ফলস বে-র আরও ১৫০ কিলোমিটার পূর্বে।
আরও পূর্বে যাত্রা করার পর, ডায়াসের নজরে পড়েছিল এক আশ্চর্য দৃশ্য। যে দুই ভিন্ন ভিন্ন রঙের জলরাশিকে তিনি মিশতে দেখেছেন সমুদ্রের মাঝে, উপকূল থেকে কয়েক মাইল গভীরে, সেই দুই জলরাশিই সরাসরি বিভেদরেখা সৃষ্টি করছে সমুদ্রতটে। সমুদ্রসৈকতে একটি পাথরফলক বসিয়ে এই অঞ্চলটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ডায়াস। পরবর্তীতে এই অঞ্চলটির নাম রাখা হয় কেপ আগুলহাস। এও প্রমাণ হয় এই বিশেষ বিন্দুটিই আসলে আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দু। কিন্তু কী কারণে দুটি ভিন্ন ভিন্ন মহাসাগরের বিভেদরেখা সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় এই অঞ্চলে?
আসলে কেপ আগুলহাসে এসে মিলিত হয় মূলত দুটি মহাসাগরীয় স্রোত। প্রথমটি বেঙ্গুয়ালা স্রোত, যা দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রবাহিত হয় উত্তর দিকে। অন্যটি ভারত মহাসাগর থেকে প্রবাহিত আগুলহাস স্রোত। বেঙ্গুয়েলা স্রোতের তাপমাত্রা আগুলহাস স্রোতের থেকে কম হওয়ার কারণেই সরাসরি মিশে যেতে পারে না এই দুই স্রোত। ফলে, তৈরি হয় ভিন্ন বর্ণের জলরাশির বিভেদসীমা। কয়েকশো কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় এই বিভেদরেখাকে।
যদিও ‘কেপ আগুলহাস’-ই যে এই দুই মহাসাগরের মিলনক্ষেত্র— তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বিস্তর। অনেকের মতে কেপ আগুলহাসের ১.২ কিলোমিটার পশ্চিমের অবস্থিত ‘কেপ অফ গুড হোপ’-ই নাকি দুই মহাসাগরের প্রকৃত মিলনস্থল। অবশ্য প্রাকৃতিক অবস্থা, সামুদ্রিক চরিত্রের এবং বাস্তুতন্ত্রের প্রকৃতি দেখলেই বোঝা যায় কেপ আগুলহাসেই মেশে দুটি মহাসাগর। তার কারণ, এই বিশেষ অঞ্চলটির পূর্বে দেখা যায় না কেল্পের অরণ্য। তার কারণ, উষ্ণ উপকূলেই বৃদ্ধি পায় এই গাছ। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কেপ আগুলহাস’ দুই মহাসাগরের মিলনক্ষেত্রের তকমা পেলেও, আধুনিক সমীক্ষা অনুযায়ী, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের এই বিভেদরেখা অবস্থান পরিবর্তন করে ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে। পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রার পরিবর্তনে কেপ আগুলহাসের পূর্বে ৬০০ মিটার থেকে পশ্চিমে ৬০০ মিটার পর্যন্ত সরে যায় এই বিভেদসীমাটি। অবশ্য মজার ব্যাপার হল, এতকিছুর পরেও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জনপ্রিয়তার নিরিখে ‘কেপ অফ গুড হোপ’, ‘ফলস বে’ বা ‘কেপ অফ স্টর্মস’-এর থেকে বহু পিছিয়ে আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দুটি। তা নিয়ে চাপা ক্ষোভও রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।
Powered by Froala Editor