‘কানেকশন ডাউন, ঘণ্টাখানেক পরে আসুন।’ — শুনেই চমকে ওঠা। দেশে থাকতে এমন শুনে-শুনে অভ্যস্ত হলেও, সুদূর কান-এও যে এই পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে, কে জানত! সোমবারের দুপুর। আগামীকাল থেকে শুরু কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। ফলে, চারপাশে শেষ-মুহূর্তের ব্যস্ততা তুঙ্গে। সেই সঙ্গে, মিডিয়া সেন্টারের সামনে বিশাল লাইন। আজকেই প্রত্যেক সংবাদমাধ্যমকে নিজের-নিজের ব্যাজ সংগ্রহ করতে হবে। এই ব্যাজ ছাড়া ভেতরে সেঁধোনো মুশকিল। কড়া পাহারা চারদিকে।
চারপাশে মুখ ফিরিয়ে, বাঙালি তো দূরের কথা, ভারতীয়ও চোখে পড়ল না তেমন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে একা আমিই, প্রহর.ইন-এর প্রতিনিধি। এই প্রথম ভারতের কোনো অনলাইন বাংলা পোর্টাল কানের দরবারে। ফলে, উত্তেজনার কমতি নেই। এখান থেকেই টের পাচ্ছি কলকাতায় প্রহরের বন্ধুদের উল্লাস। এরই মধ্যে, উচ্চারিত হল সেই অমোঘ বাক্য— ‘কানেকশন, পরে আসুন।’
ব্যাপার কী? জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, সকাল থেকে কানের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে এত লোকের ভিড়, যে, ওদের সার্ভার ক্র্যাশ করেছে। ফলে, মেশিন কাজ করছে না কিছুতেই। মিডিয়া ব্যাজ দিতেও দেরি হবে। ঘণ্টাখানেক পরে আসার অনুরোধ। হতাশার ছাপ দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের মুখে। আমার অবশ্য পোয়াবারো। এই সময়টাকে কাজে লাগানো যাক। বাইরে থেকে ঘুরে-ঘুরে দেখে নিই চারপাশের পরিস্থিতি। সেইসঙ্গে, তুলে নেওয়া যাবে প্রয়োজনীয় ছবি ও ভিডিয়ো-ও।
আরও পড়ুন
এবার আরবের মাটিতেও ফেলুদা, সৌদি চলচ্চিত্র উৎসবে 'জয় বাবা ফেলুনাথ'
কানের মূল যে হলটা, ‘প্যালে দে ফেস্টিভাল’, তার লাগোয়াই এই মিডিয়া-অফিস। খানিক পিছিয়ে আসতেই চোখে পড়ল ‘সাল্লে দেবুসি’। এতে মূলত প্রেস স্ক্রিনিংগুলোই করা হয়। আমাদের, অর্থাৎ প্রেসের লোকেদের জন্য অনেকগুলো ছবির স্ক্রিনিং আলাদা করে এই হলেই করা হবে। ডানহাতে এই হলটাকে রেখে আরও খানিক এগিয়ে গেলে, চোখে পড়বে মূল পোস্টার— জিম ক্যারির বিখ্যাত ‘ট্রুম্যান শো’, সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়ার দৃশ্য। আরও খানিক পেরোলে, পার্কের মতো একটা জায়গা। সেই পার্কের ভেতর দিয়ে এগোলেই দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। এতদিন ধরে কানে সারা বিশ্বের যত বিখ্যাত পরিচালক অভিনেতারা এসেছেন, তাঁদের অনেকেরই হাতের ছাপ বাঁধিয়ে, পাথর হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় বসানো। রাস্তার ওপরেই। শ্যারন স্টন, উমা থার্মান, টম ক্রুজদের নাম চোখে পড়ল।
আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ২
আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ১
পেছনে কান শহর, সামনে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো চলচ্চিত্র-উৎসব ‘প্যালে দে ফেস্টিভাল’। তার পিছনে সমুদ্র। যদিও সমুদ্রের সৌন্দর্যে মন দেওয়ার সময় নেই কারোরই। কাল সকাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে উৎসব। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সর্বত্র। অতএব, ও-তল্লাটে এখন প্রবেশ নিষেধ। কী আর করা! এদিক-সেদিক ঘুরে ফিরে গেলাম সেই মিডিয়া সেন্টারেই। লাইনে দাঁড়াতে, হাসিমুখে এক সুন্দরী মহিলা জানালেন, নাহ্, লিঙ্ক আসেনি এখনও।
আরও পড়ুন
শুধু ‘মন্দার’-ই নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রে একাধিকবার ছায়া ফেলেছে ম্যাকবেথ
আবার এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি। আলাপ হল আমেরিকা, ভেনেজুয়েলা, ইতালির কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে। আড্ডাও, বেশ খানিকক্ষণ। বাংলার প্রতিনিধি আমি, শুনে ওঁদের চোখে-মুখে অবাক বিস্ময়। আন্দাজ করে, হেসে বললাম, ‘ইয়েস, ফ্রম দ্য ল্যান্ড অব সত্যজিৎ রায়।’ মৃত্যুর তিরিশ বছর পরেও, সত্যজিৎ যে পরিচিতির অন্যতম সূত্র হয়ে দাঁড়াবেন, কে জানত!
ফিরে এসে দেখলাম, এবার ব্যাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। লাইনে দাঁড়াতে হল। ধীরে-ধীরে এগোচ্ছি। তিন নম্বরে যেতে-না-যেতে আবার লিঙ্ক ডাউন। এবার আর নড়াচড়া নেই। দাঁড়িয়ে থেকে-থেকে, খানিক পরে ব্যাজ নিয়েই ছাড়লাম একেবারে। ঝলমলে হলুদ রঙের কার্ড, তাতে আমার নাম, ছবি, প্রহরের নাম, আর দেশের পরিচয় বড়ো-বড়ো করে লেখা— ‘INDE’, অর্থাৎ, ভারত।
এখন আর বাধা নেই কোনো। ব্যাজ দেখিয়ে, মূল প্যালে দে ফেস্টিভালে প্রবেশ করা গেল সহজেই। অদ্ভুত সুন্দর এক জায়গা। একটা বড়ো হল, দুদিকে দুটো সিঁড়ি উঠে গেছে, নিচের দিকেও সিঁড়ি। রয়েছে এসকেলেটরও। এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করাতে, দেখিয়ে দিলেন মূল অডিটোরিয়ামে যাওয়ার রাস্তা। গিয়ে দেখলাম, হলের দরজা খোলা। ভেতরে স্টেজ রিয়ার্সাল চলছে। কালকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। কলাকুশলীরা ছাড়া, আশেপাশে নেই প্রায় কেউই। ফলে, মানা করারও কেউ নেই। কেউ আলো ঠিক করছে, কেউ আবার মঞ্চে বক্তব্য ঝালিয়ে নিচ্ছে। যে মঞ্চের ছবি এতদিন কেবল ছবি আর ভিডিয়ো-তে দেখেছি, সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা যে কী, তা লিখে বোঝানো শক্ত।
আজ করার কিছুই নেই আর। আশেপাশে আরেকটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে, বেরিয়ে এলাম। কাল সকাল-সকাল, আবার। ৭৫ বছরে পা দিচ্ছে কান চলচ্চিত্র উৎসব। এতদূর এসে পড়েইছি যখন, প্রথম দিনের সাক্ষী না থাকলে চলে! তবে, শুরুর আগের এই দিনের অভিজ্ঞতাও নেহাত কম নয়। উৎসবে তো অনেকেই আসে, উৎসবের প্রস্তুতির সাক্ষী থাকতে পারে ক-জন!
Powered by Froala Editor