Cannes-এর দরজা ঠেলে: ‘ফর দ্য সেক অব পিস’— প্রথম স্ক্রিনিং, প্রথম সবকিছু

পাশের সিটে বসে ঝরঝর করে কেঁদে চলেছেন মিরেল্ডে। সিনেমা সবে শেষ হয়েছে। প্রেক্ষাগৃহের আলোও জ্বালানো হয়নি এখনও। অনেক চেষ্টা করেও বয়স্কার কান্না থামাতে পারিনি আমি। মিরেল্ডে প্যারিস-নিবাসী চলচ্চিত্র-সমালোচক। বয়স প্রায় ৭০-এর কাছাকাছি। চেয়ারে বসে নোট নিচ্ছি দেখে, ছবির মাঝেই কানে-কানে এসে বলেছেন, চালিয়ে যাও, তোমায় দেখে আমার নিজের পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে।

কোন সিনেমা দেখে তাঁর এই অনুভূতি? এ-বছর কান চলচিত্র উৎসবের ৭৫ তম বর্ষ। আর তারই প্রথম ছবি ‘ফর দ্য সেক অব পিস’ (For The Sake Of Peace)। থমাস সামেটিন ও খ্রিস্টফ কাস্তানে পরিচালিত এই ছবি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়নি। ফেসটিভেলের (Festival De Cannes) কমিটিই ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথম এবং স্পেশাল স্ক্রিনিং করবে বলে ঠিক করে। সে কারণেই আরো উত্তেজনা বেশি। তাছাড়া প্রেস স্ক্রিনিং হওয়ায় সকলের জন্য নয়ও। তাও ‘সালে বুনুয়েল’ প্রেক্ষাগৃহের সামনে বেশ খানিকটা লাইন দেখে থমকে দাঁড়াতে হয়। লাইনেই আলাপ হয় লন্ডন-নিবাসী ফিল্ম ক্রিটিক আমিরের সঙ্গে, বয়স্ক মানুষ, ৩২ বছর ধরে কান উৎসবে আসছেন।

ফর দা সেক অফ পিস ফিচার নয়, ডকুমেন্টারি ছবি। দক্ষিণ সুদান আমাদের পৃথিবীর অন্যতম কনিষ্ঠ দেশ। ২০১১ সালে তৈরি হওয়া এই দেশ বহু অন্তর্ঘাত ও গৃহযুদ্ধের সাক্ষী। বিগত ১০ বছরে গৃহযুদ্ধে বলি হয়েছেন প্রায় চার লক্ষেরও বেশি মানুষ। ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা ধীরে ধীরে নানদেগে ও গাটজাং-এর জীবনে ঢুকে পড়ি। নানদেগে পুরুষতান্ত্রিক দক্ষিণ সুদানের দিদিঙ্গা অঞ্চলের মেয়ে। গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের দুটো প্রান্তিক অঞ্চল দিদিঙ্গা ও লগির। তাদের মাঝে অবস্থিত কেদেপো উপত্যকা। দেশ স্বাধীন হলেও এই দুই অঞ্চলের মানুষ এখনও আধুনিক সভ্যতার থেকে অনেকখানি পিছিয়ে আছেন। দিদিঙ্গা গোষ্ঠীর নেতা লোনহা ও লোরগি অঞ্চলের একছত্র একনায়ক যুদ্ধওস্তাদ কোমোল। এ ছবি যে সময়কে তুলে ধরে, সে সময়ে আধুনিক সুদানে দাঁড়িয়েও গবাদি পশুর মালিকানা ও ছিনতাই নিয়ে দুই প্রান্তিক আদিবাসী দলের মধ্যে খুনোখুনি লেগেই থাকে। ফলত সরকারি অনুমোদন ও সাহায্য পেতেও সমস্যায় পড়ে দুই গোষ্ঠীই। অবশেষে নানদেগে অপরিসীম পরিশ্রম ও লড়াইয়ের মাধ্যমেই আদিম ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজদুটোকে ইউ-এন এবং ওয়াইটেকার ফাউন্ডেশানের সহযোগিতায় বৈঠকে বসাতে রাজি করাতে পারে। সেই আলোচনায় শান্তি স্থাপনার পর নানদেগেকে আমরা বলতে শুনি,

আরও পড়ুন
‘অপরাজিত’ সত্যজিৎ ও বাংলা চলচ্চিত্রের পদাবলী

‘ইউ মাইট থিংক ওয়াট ইজ দিস ইয়াং লেডি ডুইং হিয়ার? বাট লেট মি টেল ইউ… আই রিপ্রেজেন্ট সাউথ সুদান এ্যাণ্ড নট দিদিঙ্গা। …উমেন হ্যাভ ২৫-৩৫% রেজারবেশান ইন এ্যাডমিনিস্ট্রেশান নাউ!’

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সোমবারের দুপুর, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও সত্যজিৎ-ছায়া

আরও পড়ুন
এবার আরবের মাটিতেও ফেলুদা, সৌদি চলচ্চিত্র উৎসবে 'জয় বাবা ফেলুনাথ'

অন্যদিকে গাটজাং দেশের গৃহযুদ্ধে অন্য লক্ষাধিক মানুষের মতো নিজের সমস্ত হারিয়ে বাসা বেঁধেছে জুদা অঞ্চলের পি-ও-সি অর্থাৎ প্রোটেকশান অফ সিভিলিয়ান ৩ বস্তিতে। সেখানে সে ফুটবল কোচ ও রেফারি। তার স্বপ্ন সে এই অঞ্চলের ৬০০-৭০০ মানুষকে(পুরুষ/মহিলা নির্বিশেষে) ভালো ফুটবলার হিসাবে তৈরি করবে। তার মধ্যে ২০-৩০ জনকে সে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় হিসাবেও দেখতে চায়। সেই স্বপ্নই গাটজাং-এর হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে পি-ও-সির সর্বত্র। খিদে, অভাব ও রক্তপাত মানুষের মনে সিস্টেমের প্রতি যে রাগ তৈরি করে, সেই রাগকেই ছাত্রদের খেলার মাঠে ব্যবহার করতে শেখায় কোচ গাটজাং। সবশেষে একাধিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পি-ও-সি দল ইউ-এন টিমকে খেলায় পরাজিত করে এবং আঞ্চলিক কাপে জয়লাভ করে। রেডিয়োয় শুনতে পাওয়া স্টেডিয়ামের চিৎকারে জাটগাঙের অশ্রুস্নাত চোখে চলকে ওঠে স্বপ্ন।

ডকুমেন্টারি সঙ্গে ছায়াছবির বিশিষ্ট পার্থক্য যে এডিটিং, ‘মাস্টার অফ দি ক্রাফট’-এর মতোই জুলিয়েন লেকাট ও মাতজিয়ে বার্টড ছবিটির ছত্রে-ছত্রে সে কথার প্রমাণ রেখেছেন। ডকুমেন্টারি ছবিতে গল্প বলা বা ন্যারেটিভ তৈরির কায়দা একটা বড়ো ভূমিকা নেয়, কারণ বিভিন্ন অন্তর্ঘাত বিশিষ্ট একাধিক বিষয়কে নিয়ে শেষমেশ একটাই গল্প তৈরি করাই এই ধরনের ছবির মূল চ্যালেঞ্জ। এ ছবির ন্যারেটিভে এক দিকে রয়েছে নানদেগের নারীবাদ, তার যুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড আর তার সঙ্গেই যুযুধান দুই পক্ষকে এক জায়গায় এনে তারপর ইউনাইটেড নেশানের গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে কোনোরকম অযথা আবেগ ছাড়াই দেশের প্রতি প্রশ্নাতীত ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধকে তুলে ধরার চারিত্রিক বলিষ্ঠতা। আবার অন্যদিকে গৃহযুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশে গাটজাং-এর মতো একেবারে অন্য ধারার এক মানুষের ফুটবলের প্রতি আমরণ ভালোবাসা তার ব্যক্তিগত জীবনের কষ্ট, লড়াই এবং দেশ ও সমাজের আভ্যন্তরীণ লিঙ্গবৈষম্যকেও ছাপিয়ে যায়। এই প্রত্যেকটা গল্পকে আলাদা আলাদা ভাবে গড়ে তুলে ছবির একেবারে শেষে এসে দেশীয় আফ্রিকান পার্কাশান ও পশ্চিমি ভায়োলিনের মূর্ছনায় এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে পারেন যে এডিটর যুগল, তাঁরা অবশ্যই এই শিল্পের গুরুস্থানীয়! দেখতে দেখতে আমাদের নিজস্ব ‘তানভির কা সফরনামা’ সিনেমার কথা মনে পড়ে যেতেই পারে। এছাড়া ছবিতে শব্দের ব্যবহারও রীতিমতো দৃষ্টান্তমূলক। পি ও সি টিমের ফুটবল ফাইনাল হোক বা ইউ-এন এর বিশিষ্ট টিমের সঙ্গে তাদের খেলায়; পায়ের তালে তালে চলতে থাকা ভায়োলিন, চেলো বা পার্কাশানের মূর্ছনায় কখন যেন দর্শক মন দৃষ্টি ছাপিয়ে কেবল শব্দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়।

সবশেষে যেটুকু বলার, আমাদের সমকালীন পৃথিবীর সামগ্রিক প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয়, মৃত্যু, ও হিংস্র আদিমতার মাঝেও মানবিক চেতনা ও অগ্রগতির প্রতি বিশ্বাসই এ ছবির মূল উপপাদ্য। তাই দক্ষিণ সুদানের দুটি প্রত্যন্ত গ্রামের যুদ্ধপরিস্থিতির কাহিনি হিসাবে শুরু হয়েও এ ছবি নানদেগে ও গাটজাং-এর দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই আর তারই মাঝে ক্ষণে-ক্ষণে উকি দেওয়া তাদের উজ্জ্বল হাসির ভেলায় দেশ-কাল উপেক্ষা করে আমাদের মানবতার উঠোনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন ফুটবল, যুদ্ধবিরোধিতা, সাম্যবাদের মতো কবিতাগুলোই হয়ে ওঠে হাজার রক্তক্ষয়েও মানুষের বাঁচতে চাওয়ার, ভালো থাকতে চাওয়ার প্রবল আকুতি। সেকারণেই এ-ছবির শেষে অঝোরধারায় কাঁদতে কাঁদতে মিরেল্ডের মতো বিদগ্ধা বলে বসেন, ওয়াট পিপল! অ্যান্ড উই আর ফাইটিং ওভার ওয়াটসঅ্যাপ সেলফিজ!

এ ছবি যেন কবি নজরুল ইসলামের সেই পংক্তিদুটির দেশান্তরী অনুরণন— ‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি…’

সিনেমা – ফর দ্য সেক অব পিস
কান ফিল্ম ফেস্টিভালের প্রথম স্ক্রিনিং
পরিচালক – থমাস সামেটিন ও খ্রিস্টফ কাস্তানে
সম্পাদনা – জুলিয়েন লেক্যাট, মাটজিয়ে ব্রেটোড
গোত্র – ডকুমেন্টরি
দেশ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More