ঘুম থেকে উঠে চায়ের সঙ্গে একটু ‘টা’, আর সঙ্গে একটা খবরের কাগজ— বাঙালির সকাল শুরু হয় এমনভাবেই। আর দিন শেষ হয় রাতের আলোয় বই পড়া দিয়ে। অক্ষর আর কাগজের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তো আজকের নয়। সেই আঠেরোশো শতক থেকে যাত্রা শুরু। মনে পড়ে বিভূতিভূষণের কিশোর অপু’র কথা। ছাপাখানার কাজ, নতুন কাগজ, আঠার গন্ধ, পাতলা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে থাকা রোগাটে এক কিশোর কাজ করে যাচ্ছে। সঙ্গে মেশিনের ঘটর ঘটর শব্দ— সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরা পুরো বিষয়টাকেই ধরে রেখেছিল। ছাপাখানা, বই আর শব্দের এই চিরন্তন সম্পর্ক কোথাও আমাদের আবহমান ঐতিহ্যের মধ্যেও ঢুকে গিয়েছে।
বাংলার প্রথম ছাপাখানা কোনটি? এই বিষয় সামান্য মতভেদ আছে। কারোর মতে, হুগলিতে নাথানিয়েল ব্রাসলে হালেদ ও চার্লস উইলকিনস প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানাই প্রথম। আবার অন্য মত অনুযায়ী, কলকাতার জেমস অগাস্টাস হিকির ছাপাখানা প্রথমে শুরু হয়েছিল। তবে দুটোই যে খুব কাছাকাছি সময় প্রতিষ্ঠিত, তা বলাই যায়। এঁদের কথায় আসার আগে ছুঁয়ে যেতে হবে একটি অখ্যাত ক্যালেন্ডারকে। ১৭৭৭ সালে যোহান জাকারিয়া কিয়েরনানডার নামের এক পাদ্রি বাংলার ছাপাখানায় একটি বিশেষ ক্যালেন্ডার তৈরি করতে আগ্রহী হন। সেই সুবাদেই ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় ‘Calender for the year of our Lord MDCCLXXVIII Calculated to the Meridian of Calcutta’। নতুন হলেও ছাপাখানা তখন এসে গেছে বাংলায়। তার হাত ধরেই এই ক্যালেন্ডারের প্রকাশ। তবে উল্লেখ্য, এই ক্যালেন্ডারটি কিন্তু ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। বাংলা অক্ষরের সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ ছিল না।
এবার আসা যাক আসল কথায়। ১৭৭২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে ভারতের মাটিতে পা রাখলেন বছর বাইশের এক যুবক। নাম নাথানিয়েল ব্রাসলে হালেদ। কাজ করতে করতে ক্রমশ বাংলার গভীরে ঢুকে পড়া, অতঃপর বাংলা ভাষা শেখা। একসময় নাথানিয়েল ঠিক করলেন, একটা আস্ত বই লিখবেন। তখন কর্মসূত্রে তিনি হুগলিতে। একটু একটু করে লিখে ফেললেন ‘আ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’। ইংরেজি নাম দেখে ঘাবড়ে যাবেন না। বইটির মূল ভাষা কিন্তু বাংলাই। লিখে তো ফেললেন, এবার ছাপতেও তো হবে! নাথানিয়েল হালেদের সঙ্গে হুগলিতে কাজ করতেন চার্লস উইলকিনস। ছাপাখানার হরফ তৈরির কাজে তিনি বেশ পটু। কিন্তু সে তো ইংরেজি হরফ। বাংলার বেলায়? এবার এগিয়ে এলেন এক বাঙালি, পঞ্চানন মল্লিক (কর্মকার)। হুগলিতেই শুরু হল ছাপাখানার পথ চলা। এক বছর পর ১৭৭৮ সালে বেরোল বাংলা হরফে ছাপা প্রথম বইটি। সৃষ্টি হল ইতিহাস…
ইতিমধ্যে কলকাতাও একটা যুগান্তকারী ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। জেমস অগাস্টাস হিকি নামে এক ব্রিটিশ সাহেব প্রায় ঐ সময়ই কলকাতার বুকে তৈরি করেন নিজের একটি ছাপাখানা। বাংলার মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাস এই দুই জায়গাকে এক করে দেয়। হুগলি আর কলকাতার হাত ধরে যে যাত্রাটা শুরু হয়, পরবর্তীতে সেটাই দিশা দেখায় গোটা বাংলাকে। কলকাতার নিজের ছাপাখানা থেকেই ১৭৮০ সালে হিকি সাহেব বের করলেন নিজস্ব সংবাদপত্র— ‘হিকির বেঙ্গল গেজেট’। বাংলার প্রথম সংবাদপত্র। ইতিহাসের ভেতর দিয়েই তৈরি হয়েছিল আরও একটি ইতিহাস। পরবর্তীকালে এই সারণি ধরেই উঠে আসা গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বাঙ্গাল গেজেট’; যা কিনা বাংলা ভাষার আদি সংবাদপত্র। আজ অবশ্য এই বিশেষ পত্রিকাটির কোনো সংখ্যারই অস্তিত্ব নেই। ছিল গঙ্গাপ্রসাদের নিজস্ব ‘বাঙ্গালী প্রেস’। অনুপ্রেরণা সেই হিকি সাহেব আর হুগলির নাথানিয়েল সাহেব…
আরও পড়ুন
মাস্কে ছাপা মানুষের মুখের ছবি, অভিনব উদ্যোগ কেরালার ডিজিট্যাল ফটোগ্রাফারের
তবে শেষ মুহূর্তে এসে আরেকটি জায়গার নাম না করলেই নয়। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস থেকেই বাংলা ভাষায় বাইবেল প্রকাশিত হয়। ধর্ম প্রচারের কাজে, শিক্ষা প্রচারের কাজে এই প্রেসের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। উইলিয়াম কেরির সঙ্গে এখানে যুক্ত হন মুদ্রণ বিশারদ উইলিয়াম ওয়ার্ড। পরবর্তীতে হরফ শিল্পী হিসেবে পঞ্চানন কর্মকারও এখানে যোগ দেন। বাংলার মুদ্রণ শিল্প চর্চা এগিয়ে চলে দুর্বার গতিতে। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে শ্রীরামপুর প্রেসের নাম এবং সেখানকার কাজের কথা। শুধু বিদেশি পাদ্রি, সাহেবরাই নন; বাঙালিরাও এই বিরাট কর্মোদ্যোগের সাক্ষী থাকেন। আজ উন্নত ব্যবস্থা, উন্নত যন্ত্র, প্রযুক্তি এসেছে। লেটারপ্রেস, অফসেট থেকে ডিজিটাল দুনিয়া— সবেরই সাক্ষী থেকেছি আমরা। কিন্তু আঠেরোশো শতকের শেষের দিকের মুদ্রণ-বিপ্লবকে কি ভোলা যায়?
ঋণ - ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন
আরও পড়ুন
কলকাতায় বসেই ছাপাখানার নতুনত্বে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর
Powered by Froala Editor