বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাউদ্দৌলা। ভারতের ইতিহাসের বিতর্কিত চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম তো অবশ্যই। তাঁর সিংহাসন আরোহণের উদ্দেশ্য কী ছিল, আদৌ তাঁর কোনো জাতীয়তাবাদী পরিকল্পনা ছিল কিনা, প্রায় সমস্ত দেশীয় জমিদার তাঁর বিরুদ্ধেই বা কেন দাঁড়িয়েছিলেন; এসব কোনো প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলা তো বটেই, ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্যের স্বাধীনতার সূর্য তাঁর ব্যর্থতার চিহ্ন মাথায় নিয়েই অস্ত গিয়েছিল পলাশির তীরে। অবশ্য ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন যে নাটকের যবনিকা পড়েছিল, তার সূত্রপাত ঘটেছিল বছর খানেক আগেই। বলা ভালো, সিরাজের সিংহাসন আরোহণের সময়, ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬।
ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার নবাবের সংঘাত কিন্তু বেশ পুরনো। অবশ্য আলিবর্দী পর্যন্ত প্রত্যেকেই মোটামুটি একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা করতেন। কিন্তু দিনে দিনে ব্রিটিশ বণিকদের সাহস বেড়েই যাচ্ছিল। কলকাতার বুকে তাদের দূর্গের বহরও বেড়ে চলেছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের অনুমতি ছিল শুধু ব্যবসা বাণিজ্য করার। তার জন্য দূর্গের কী প্রয়োজন, আলিবর্দীও এই প্রশ্নের উত্তর পাননি। ফলে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তখনই।
সিরাজ সিংহাসনে বসা মাত্রই মুখোমুখি দুই প্রতিপক্ষ। একদিকে সিরাজ উঠেপড়ে লাগলেন ব্রিটিশদের জব্দ করতে। অন্যদিকে ব্রিটিশ গভর্নর ড্রেকের সঙ্গে দেশীয় রাজাদের আঁতাত আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বাংলার শাসক হিসাবে সিরাজকে মেনে নিতে পারেননি কেউই। এমনকি তাঁর বড়মসি ঘসেটি বেগমও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। সেকথাও জানতে পেরেছিলেন সিরাজ। তাঁকে তাই মতিঝিল প্রাসাদ থেকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের হীরাঝিল প্রাসাদে নজরবন্দি রাখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ষড়যন্ত্র দমনের তেমন উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সিরাজ নিলেন না। এর কারণ অবশ্য জানা যায়নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ শক্তিকে সমূলে উৎখাত করতে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন তরুণ নবাব। সঙ্গে বিশাল সেনাবাহিনী।
অবশ্য শুরুতেই আক্রমণ করলেন না সিরাজ। তৎকালীন ভারতের সমূচিত আদব কায়দা তো শিখিয়ে দিতে হবে ব্রিটিশদের। তাই আক্রমণের আগে নারায়ণ দাস নামের এক দূতকে পাঠালেন ড্রেকের কাছে। শর্ত ছিল দুটো। প্রথমত, দুর্গ সংস্কার বন্ধ করতে হবে। আর দ্বিতীয়ত, দেওয়ান রাজবল্লভের পলাতক পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে নবাবের হাতে সমর্পণ করতে হবে। কিন্তু এই দুই শর্ত শোনা মাত্রই গর্জে উঠলেন ড্রেক, অসম্ভব। অতএব যুদ্ধ ছাড়া কোনো রাস্তাই খোলা থাকলো না।
আরও পড়ুন
ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে ভারতে চে গ্যেভারা, কলকাতায় আলাপ ‘কৃষ্ণে’র সঙ্গেও
নবাবের সসৈন্যে আসার খবর পেয়েই বাগবাজারের পেরিন্স পয়েন্টে তৈরি ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গে ছিল পর্তুগিজ এবং হিন্দু ফৌজ। কিন্তু সিরাজের বাহিনী এসবের জন্য তৈরি হয়েই এসেছে। দিনটা ১৫ জুন, ১৭৫৬। সিরাজের বাহিনীর এসে দাঁড়ালো কলকাতার উপকণ্ঠে। সুশিক্ষিত নবাবি সেনাবাহিনীর কাছে ব্রিটিশ বাহিনী আদৌ দাঁড়াতেই পারছিল না। তবুও তিনদিন ধরে চলল যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ১৮ জুন লালদীঘির যুদ্ধে পরাজিত হল ব্রিটিশ বাহিনী।
আরও পড়ুন
কেন্দ্রের তালিকায় প্রথম দশে যাদবপুর, কলকাতা; স্থান পেল রাজ্যের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও
পরদিন ভোর হতে না হতেই হুগলি নদীর ঘাট থেকে ছেড়ে গেল কয়েকটি নৌকা। সামান্য কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া ব্রিটিশদের সকলেই কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন। কলকাতা শহর দখল করলেন নবাব। নাম রাখলেন, আলিনগর। প্রিয় দাদুর প্রতি এই ছিল নাতির শ্রদ্ধার্ঘ। ২০ জুন পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বসল এক বিরাট সভা। সেখানে উপস্থিত কলকাতার অভিজাত ব্যক্তি উমিচাঁদ এবং পলাতক কৃষ্ণবল্লভ। দুজনেই মেনে নিলেন সিরাজের আধিপত্য। আর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গ পরিচালনার ভার দিয়ে সিরাজ ফিরে এলেন রাজধানী মুর্শিদাবাদে।
আরও পড়ুন
বাংলার ‘ডব্লিউ জি গ্রেস’ সারদারঞ্জন, কলকাতায় ক্রিকেটের সরঞ্জামের প্রথম দোকানও তাঁরই
বাংলার ভাগ্যাকাশে সেদিন রৌদ্র ঝলমল করে উঠেছিল ঠিকই। তবে দক্ষিণে মেঘ জমতে শুরু করেছিল সেদিনই। ব্রিটিশদের রুখে দাঁড়াতে ঠিক ৬ মাসের বেশি সময় লাগেনি। আর পরের বছর ২৩ জুন সমস্ত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে বাংলায় নবাবি শাসনের শেষ ঘোষিত হল। এদেশের ইতিহাসের চর্চায় পলাশির যুদ্ধের বর্ণনা যতটা পরিচিত, কলকাতার যুদ্ধ কিন্তু ততটা নয়। দক্ষিণের আলিপুর অঞ্চলের নামের মধ্যে যে আসলে সেই আড়াই শতক আগের ইতিহাস লুকিয়ে আছে, সেখবর আর কজন রাখেন?
আরও পড়ুন
১৮৬৪ সালের সাইক্লোনে তছনছ বাংলা, মৃত ৬০ হাজার; ভেসে গিয়েছিল কলকাতাও
তথ্যসূত্রঃ কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ মিত্র
আরও পড়ুন
এশিয়ার প্রথম গ্রিক গির্জা কলকাতাতেই, বাসিন্দার সংখ্যা কমতে কমতে মাত্র এক
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
২২ বছর লুকিয়ে ছিলেন কলকাতায়, অবশেষে গ্রেপ্তার বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী