বাড়িতে বসে, বই খুলেই পরীক্ষা; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়া সিদ্ধান্ত ও কিছু সংশয়

আবার শিক্ষাব্যবস্থা। আবার একটি সিদ্ধান্ত, এবং, আবারও সেই নিয়ে বিতর্কের আগুন। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু এবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অন্তিম বছরের পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু তাই নয়, এই পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীরা বই খুলেই পরীক্ষা দিতে পারবেন। বাড়ি থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া কিংবা উত্তরপত্র জমা দেওয়া— পুরো বিষয়টাই হবে অনলাইনের মাধ্যমে। এর জন্য ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছে, পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখে মান বিচার করবেন নিজের নিজের কলেজের শিক্ষকেরাই। পরীক্ষা চলবে ১ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর, উভয় পরীক্ষারই ফলাফল প্রকাশ করা হবে ৩১শে অক্টোবরের মধ্যেই।

কীভাবে হবে এই পরীক্ষা? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, পরীক্ষার্থীরা প্রশ্নপত্র পাবেন ওয়েবসাইট, ইমেল অথবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর উত্তরপত্র জমা দিতে হবে অনলাইনেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, দেশজুড়ে যখন করোনা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করছে, প্রায় প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা, তখন কেন এত তড়িঘড়ি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালী চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ইউজিসির নিয়ম মেনেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে, এমনকি ভারতের বেশ কিছু জায়গাতেও এই ধরনের ‘ওপেন বুক এক্সামিনেশন’-এর প্রচলন থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই ঘটনা নতুন। স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে। কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে সময় শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাবর্ষের সম্পূর্ণ সিলেবাস শেষ হয়নি তখনও। যদিও উপাচার্য জানাচ্ছেন যে, যতদূর পর্যন্ত শেষ হয়েছিল সিলেবাস, তার ভিত্তিতেই পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, তাহলে পরীক্ষাটাই কি সব? সিলেবাস শেষ না হওয়ার ফলে যে বিষয়গুলি সম্বন্ধে ছাত্রছাত্রীদের জানা হল না, তার কী ব্যবস্থা করা হবে? এছাড়াও যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ইন্টারনেট পরিষেবা না থাকার দরুন অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার সম্ভাবনাও দূর অস্ত্, তাদের ক্ষেত্রে তাহলে কী ব্যবস্থা হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত, সে ক্ষেত্রে কেউ যদি উত্তরপত্র অনলাইনে জমা দিতে না পারে, তাহলে তাকে হার্ডকপি পৌঁছে দিতে হবে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে।

প্রশ্ন উঠছে আরও একটি বিষয় নিয়ে। বাড়িতে বসে ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই পরীক্ষা দিচ্ছেন নাকি কেউ তাকে পাশ থেকে সাহায্য করছেন, সেই ব্যাপারে নজরদারির কী হবে? যদি ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা পরীক্ষা না-ই দেয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে মান বিচার করাও একটা হাস্যকর পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং মুড়ি ও মিছরির এক দর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও যে থাকছে, তা বলাই বাহুল্য।

আরও পড়ুন
মাত্র তিনমাসের নোটিশেই ছেঁটে ফেলা যাবে সরকারি কর্মচারীদের, বিতর্কিত সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের

এর আগে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনলাইন পরীক্ষাই নেওয়া হবে। কিন্তু সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর থেকেই এসেছিল বিরোধিতা। অনলাইন পরীক্ষার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট যুক্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছিল সোশিওলজি ডিপার্টমেন্ট। অনলাইন পরীক্ষার বদলে ছাত্র-ছাত্রীদের সেমিস্টার এবং আভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের ভিত্তিতে একটি আনুমানিক নম্বর দেওয়ার প্রস্তাব জানানো হয়েছিল ওই বিভাগের তরফে। 

মূলত যে যুক্তিগুলি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তরফে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো কিন্তু একদমই ফেলে দেওয়া যায় না বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে। যে মূল তিনটি বিষয় তারা জানিয়েছিল সেগুলি হল, অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়ার অনভিজ্ঞতা, ডিজিটাল কোর্সের জন্য যথাযথ কোর্স মেটিরিয়াল না থাকা, এবং ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবন্ধকতা। কোনোরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা অথবা প্রস্তুতি ছাড়াই ওপেন বুক স্টাইলে পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতিও সঠিক নয় বলে জানিয়েছিল তারা। মতামত দিয়েছিলেন শিক্ষাবর্ষ একবছর বাড়ানোর জন্য। অর্থাৎ শুধুমাত্র পরীক্ষা নেওয়া নয় বরং ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার দিকটিই গুরুত্ব পেয়েছিল তাদের সিদ্ধান্তে।

আরও পড়ুন
‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ অপরাধী ক্ষুদিরাম বসু; সত্যিই অনিচ্ছাকৃত ভুল, নাকি...

শুধু পরীক্ষা পদ্ধতিই নয়, ক্ষোভ দেখা দিয়েছে পরীক্ষার আগে প্রোজেক্ট জমা দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও কোনও বিভাগের ক্ষেত্রে নোটিশ দেওয়া হয়েছে একদিনের মধ্যে প্র্যাকটিক্যালের প্রোজেক্ট জমা দেওয়ার জন্য। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই বলছেন যে, সুন্দরবন বা সেরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাদের বাড়ি, তারা কী করবেন এই পরিস্থিতিতে? নিজস্ব কম্পিউটার বা ল্যাপটপ তো দূরের কথা, সাইবার ক্যাফে অবধি নেই অনেক জায়গায়। তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে, প্র্যাকটিক্যাল প্রোজেক্টগুলো করার ক্ষেত্রে প্র্যাকটিকাল অভিজ্ঞতাটাই হচ্ছে না ছাত্রছাত্রীদের। নেহাতই দায়সারা গোছের কিছু রিপোর্ট তৈরি করে জমা দিতে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে।

তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যতই ইউজিসির দোহাই দিয়ে তড়িঘড়ি পরীক্ষা পদ্ধতি শেষ করার কথা বলুক না কেন, আদতে তাতে উচ্চশিক্ষার মান ঠিক কতটা উন্নত হবে তাই নিয়ে কিন্তু প্রশ্নের কাঁটাটা থেকেই যাচ্ছে। তার উপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মাথায় রাখলে কপালে চিন্তার ভাঁজটা আরো বাড়তে বাধ্য বৈকি। তবে আশা করা যায়, হাতে এখনও যেটুকু সময় আছে তার সদ্ব্যবহার করে এই পরীক্ষা পদ্ধতিকে নিখুঁত করার চেষ্টা করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক দিশা পাবে, নিশ্চিন্ত হবে তাদের ভবিষ্যৎ, সেটাই এখন একমাত্র কাম্য।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More