“বেদ, রামায়ণ কিংবা মহাভারত— এই সবকিছুই তো আদতে শ্রুতি। পরবর্তীকালে সম্রাট আকবরের আমলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে উর্দু গল্পকথন শিল্প ‘দাস্তানগোই’। সবক্ষেত্রেই একজন বক্তা গল্প বলেন আর তাঁকে ঘিরে বসে সেই গল্প শোনেন শ্রোতারা। বাংলায় যেটাকে আমরা কথকতা বলি, সেই শিল্পটাই হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অথচ ইউনেস্কো এই শিল্প মাধ্যমটিকে ইনট্যানজিবল হেরিটেজ হিসাবে ঘোষণা করেছে।”
বলছিলেন সুপর্ণা দেব। কলকাতার গল্পকথন শিল্পপ্রতিষ্ঠান (Storytelling Organization) ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’-র (Calcutta Karavan) অন্যতম সদস্যা তিনি। একপ্রকার অবলুপ্ত হতে বসা প্রাচীন ‘দাস্তানগোই’ শিল্পটিকেই বাঁচিয়ে রেখেছে কলকাতার এই সংগঠন।
আজ থেকেই শুরু হয়েছে তিনদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’ (Kolkata Poetry Confluence)। সল্টলেকের ইউজেডসিসি-তে বসেছে এই উৎসবের আসর। এক ছাদের তলায় জড়ো হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রায় ১৫টি ভাষাভাষির কবিরা। কবিতার পাশাপাশি গান, অভিনয় ও নানাবিধ উপস্থাপনার মাধ্যমে কবিতার উদযাপন চলবে আগামী দু-দিনও। এই অনুষ্ঠানকেই আরও রাঙিয়ে তুলছে ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’-র গল্পকথন। আগামী ১১ ও ১২ তারিখ কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানকে গল্পের ছলে বেঁধে রাখবেন ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’-র শিল্পীরাই।
আরও পড়ুন
অপেক্ষার অবসান, আজ থেকে শুরু হচ্ছে ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’
সে-কথায় না হয় ফেরা যাবে আবার। আশ্চর্যের বিষয় হল, লেখিকা এবং শিল্পীর বাইরেও আরও একটি পরিচয় রয়েছে সুপর্ণা দেবের। তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিস আধিকারিক। কিন্তু সেই দুনিয়া থেকে কীভাবে গল্পকথনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া? কীভাবেই বা শুরু হয়েছিল ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’-র পথ চলা? এই প্রশ্নের উত্তরে খানিক হেসে সুপর্ণা জানালেন, “এই পেশায় থেকে যেমন অনেকে গান করেন, কবিতা লেখেন, সেভাবেই এই মাধ্যমটি বেছে নিয়েছি আমি। এখন তো আর কেউ গল্প শুনতে চায় না। এই হারিয়ে যাওয়া আর্ট ফর্মটা বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্যও।”
আরও পড়ুন
গানের মাধ্যমেই সংবাদপ্রেরণ, ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’-এ খোঁজ হারানো লোকশিল্পের
আরও পড়ুন
ভারতে এই প্রথম কবিতা উপস্থাপনা ইকারো ভালদেরামার, নেপথ্যে কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স
বছর চারেক আগের কথা। সুপর্ণা তখন দিল্লিতে। সে-সময় এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে খ্যাতনামা গল্পকথক আসিফ খান দেহেলভির সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। দিল্লির গল্পকথন সংগঠন ‘দিল্লি কারোয়াঁ’-র অন্যতম কর্ণধার আসিফ। তাঁর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরেও বাংলায় এমনই একটি অনুরূপ সংগঠন তৈরির ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেন সুপর্ণা। তাঁর কথায়, “আমাদের বাংলা সাহিত্যে কন্টেন্টের পরিধি সুবিস্তৃত। এখানে কন্টেন্টের অভাব নেই কোনো। মনে হয়েছিল, সঠিকভাবে সেগুলি পরিবেশন করলেই এই হারিয়ে যাওয়া শিল্প মাধ্যমটিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারি আমরা।” নিঃসংকোচেই সুপর্ণা জানালেন, আজও আসিফ খান দেহেলভিকেই গুরুর আসনে বসান তিনি।
২০১৮ সালে সেভাবেই পথচলা শুরু হয়েছিল ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’-র। সুপর্ণা দেব-এর সঙ্গে এই দল তৈরিতে সমানভাবে যুক্ত ছিলেন উর্দু অনুবাদক, লেখিকা, নাট্য পরিচালক এবং গবেষক সঞ্চারী সেন। সেইসঙ্গে ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’-র জন্মলগ্ন থেকেই গল্পকথনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছেন সুতনু সরকার। প্রতিটি মঞ্চানুষ্ঠানেই ঝংকার তোলে তাঁর এসরাজ। তৈরি করে এক মায়াবী পরিবেশ।
আগামীকাল ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’-এর মঞ্চেও জন্ম নেবে এক মায়াবী আবহ। গতকাল থাকছে অতিথি কবিদের কবিতাপাঠের প্রথম পর্ব। সেই অনুষ্ঠানেই কবিতাপাঠের ফাঁকে ফাঁকে ‘গল্প’ বলবেন সুপর্ণা-সঞ্চারী। গল্পচ্ছলেই পরিচয় করিয়ে দেবেন ভিন্ন ভিন্ন ভাষার বিশিষ্ট কবিদের সঙ্গে। “প্রথমদিনের কবি-তালিকায় মহিলা কবিদের আধিক্য বেশি। এই বিষয়টি মাথায় রেখে, মেয়েদের জাগরণ মহিলা কবিদের লেখায় কীভাবে উঠে এসেছে, তা দিয়েই একটি গল্প বেঁধেছি আমরা। এই গল্পের ফাঁকে ফাঁকেই কবিদের আমরা মঞ্চে ডেকে নেব”, জানালেন সুপর্ণা।
বলাই বাহুল্য, এর আগে কলকাতা এহেন কবিতাপাঠের সাক্ষী থেকেছে কিনা, সন্দেহ আছে তা নিয়ে। দ্বিতীয় দিনের ‘ক্যালকাটা কারোয়াঁ’-র অনুষ্ঠানটি আরও একটু ভিন্ন ধরনের। জানা গেল, এই অনুষ্ঠানটি গোটাটাই বাঁধা হয়েছে ছোটো ছোটো লোককথা দিয়ে। সেখানে যেমন ধরা পড়েছে বাল্মীকির শ্লোক, তার ইতিহাস; তেমনই ওড়িয়া, মহারাষ্ট্র কিংবা অহমিয়া ভাষায় প্রচলিত গল্পকথা। সেইসকল গল্পের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে অতিথি কবিদের লেখার সাযুজ্য খুঁজে নিয়েই মঞ্চে ডেকে নেওয়া হবে তাঁদের। এ-যেন প্রেক্ষাপট একই রেখে কখনও অতীতে ফিরে যাওয়া, আবার পরক্ষণেই ফিরে আসে আজকের সময়ে, আজকের সাহিত্যে।
অভিনব এই অনুষ্ঠান ভারতীয় সাহিত্যের দুনিয়ায় এক নজির তৈরি করতে চলেছে, তাতে আর সন্দেহ কই? অবলুপ্তপ্রায় গল্পকথন শিল্পকে জিইয়ে রাখার এই অভিনব প্রয়াসের সাক্ষী থাকবে কলকাতা তথা বাংলাও…
Powered by Froala Editor