সারাদিন রেস্তোরাঁর বাইরে লাল কিংবা হলুদ ইউনিফর্মে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁরা। সঙ্গে মোটরবাইক। পিঠে খাবার বহনের বড়ো বাক্স। হ্যাঁ, জোম্যাটো বা সুইগির ‘ডেলিভারি বয়’-দের কথাই বলছি। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে তাঁরা নিজের নাওয়া-খাওয়া ভুলেই প্রস্তুত থাকেন প্রতিমুহূর্তে। কয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করে পৌঁছে দিয়ে আসেন মহার্ঘ্য পদ। কিন্তু তাঁদের খোঁজ ক’জন রাখি আমরা? এবার তাঁদের জন্য এক অভিনব উদ্যোগ নিলেন ‘আউধি বিরিয়ানি’ এবং ‘ক্যালকাটা ৬৪’-এর কর্ণধার দেবজ্যোতি পাল। নিজের রেস্তোরাঁর সঙ্গে জড়িত সমস্ত জোম্যাটো-কর্মীদের জন্য আয়োজন করলেন মধ্যাহ্নভোজের।
“আমার ক্যাফের বয়স পাঁচ বছর। শুরু থেকেই জোম্যাটো আমাদের পার্টনার। আমরা লক্ষ্য করি ওরা নিজেদের লাঞ্চ, ডিনার স্কিপ করে কাস্টমারদের জন্য দৌড়ায়। আর বিজনেস পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখতে গেলে, আমাদের অনলাইন ব্যবসা পুরোটাই নির্ভর করে থাকা ওদের ওপরে। এই প্যান্ডেমিকের সময়ে সবকিছু উপেক্ষা করে ওরা এই কাজটা করেছে। তো সেখান থেকেই একটা ধন্যবাদজ্ঞাপন। বিষয়টাকে অ্যাপ্রিসিয়েশন জানানো...”, বলছিলেন দেবজ্যোতিবাবু।
বর্তমান সময়ে, একাধিকবার উঠে এসেছে এর একদম বিপরীত ছবি। খাবার পৌঁছানোয় দেরি হওয়ার কারণে অপমান-অবমাননা তো বটেই, এমনকি হাত পর্যন্ত তোলা হয়েছে জোম্যাটোর কর্মীদের গায়ে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই উদ্যোগ সত্যিই একটি দৃষ্টান্ত। তা যেন হারিয়ে যেতে বসা মানবিকতার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। দেবজ্যোতিবাবু বললেন, “সাধ্যের মধ্যে থাকলে ছোটো-বড়ো সব ধরণের প্রতিষ্ঠানেরই উচিৎ এমন উদ্যোগ নেওয়া। অনেকে হয়তো করছেও, কিন্তু আমরা জানতে পারছি না সেভাবে। এই উদ্যোগ নেওয়ার আরও একটি কারণ হল, আরও পাঁচজন যেন আগ্রহী হন এমন কাজে। একটা মানুষ তো আরেকটা মানুষের থেকে কোনো অংশে কম নয়। সেটাই বোঝানোই আমার মূল লক্ষ্য ছিল।”
এমন এক আয়োজনে আপ্লুত জোম্যাটোর কর্মীরাও। জোম্যাটোকর্মী বিবেক সাউ জানালেন, “আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম আমাদের যখন আমন্ত্রণ করা হয়। সেই মুহূর্তটাই একেবারে অন্যরকম ছিল। আসলে আমাদের কাজটা এমন, যে সবসময় আমরা ব্যস্ত থাকি। সেখানে সহকর্মীরা মিলে একসঙ্গে বসে খাব বা আড্ডা দেব, সেটা হয়ে ওঠে না। সেদিন সবাই মিলে লাঞ্চ করলাম, আড্ডা দিলাম। এই সুযোগটাই সবথেকে বড়ো পাওনা। দেবজ্যোতিবাবুও ছিলেন। উনিও গল্প করলেন আমাদের সঙ্গে। আর সত্যি কথা বলতে গেলে ওঁর এবং ক্যালকাটা ৬৪-এর প্রতিটি স্টাফের ব্যবহারই খুব ভালো। ওঁরা টাকা দিয়ে একদমই বিচার করেন না বিষয়টিকে। মানুষকে মানুষের মতো করেই দেখেন।”
আরও পড়ুন
পুরনো টিভি সেটই হয়ে উঠছে পথের প্রাণীদের আস্তানা, মানবিক উদ্যোগ আসামের যুবকের
এমন একটা সমাজই তো চাই আমরা। যেখানে প্রত্যেকে তাঁদের যোগ্য সম্মানটুকু পাবেন। উপেক্ষা না করে, সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে সকল কর্মক্ষেত্রের মানুষকেই। দেবজ্যোতিবাবুর থেকে জানা গেল এমন উদ্যোগ এই প্রথম নয়। এর আগেও বহু উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি খাদ্য-সরবরাহকারীদের জন্য। রেস্তোরাঁয় বন্দোবস্ত করেছেন তাঁদের জন্য বসার জায়গার। ব্যবস্থা করেছেন খাবার জলেরও।
জানা গেল, কর্মী এবং গ্রাহকদের সাংস্কৃতিক দক্ষতাগুলিকে তুলে আনতে তিনি প্রকাশ করেন একটি ত্রৈমাসিক বুলেটিন। নাম ‘ক্যালকাটা ৬৪ স্টোরিস’। দেবজ্যোতিবাবু জানালেন, “অনেকেই আছেন যাঁরা ট্যালেন্টেড। কেউ লেখেন, কেউ ছবি আঁকেন। কিন্তু সেটা কোথায় প্রকাশ করবেন তাঁরা জানেন না। তাঁদের জন্যই এই প্ল্যাটফর্মটা তৈরি করে দেওয়া। তাছাড়া রাস্তার ইলেকট্রিক বক্সগুলি পরিষ্কার করে সেখানে ডুডল আর্টও করা হয়েছিল আমাদের পক্ষ থেকে। মাঝেমাঝে বৃক্ষরোপণও করি আমরা। আসলে যে সোসাইটিতে আছি, সেটাকেই একটু সাজিয়ে রাখা আরকি।”
আরও পড়ুন
চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্য কম্বল বিতরণ, মানবিক উদ্যোগ জলপাইগুড়িতে
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ক্যালকাটা ৬৪-এর এই ব্যতিক্রমী ‘অভিযান’ সত্যিই অনবদ্য। এই হিংসা, অসহিষ্ণুতার মধ্যে দাঁড়িয়েও এই উদ্যোগ আশ্বাস দিচ্ছে আমাদের। বুঝিয়ে দিচ্ছে, চাইলেই ছোট ছোট পদক্ষেপ বদলে দিতে পারে আমাদের চারপাশটাকে। সমাধানের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন দেবজ্যোতিবাবুর মতো মানুষরা। এখন আমদেরই ঠিক করতে হবে, কোন পথ কোনটা বেছে আমরা…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বৃদ্ধ চারাগাছ বিক্রেতার পাশে শহরবাসী, মানবিক দৃশ্য বেঙ্গালুরুতে