ধরা যাক, কোনো চাকরিভীরু কর্পোরেট সন্ধের ক্যাফেতে বসে লড়াই করছে নিজের সঙ্গে। ঠিক তখনই, পাশের টেবিল থেকে উঠে আসা প্রায় সমবয়সি এক যুবক পাগলের মতোকাঁদতে কাঁদতে সংলাপ বলে চলেছে - 'That day I killed the actor in me forever.' আধুনিক তিলোত্তমার বুকে এভাবেই জীবন ও অভিনয়কে মিলিয়ে দিচ্ছে ক্যাফে থিয়েটার। সৌজন্যে শহরের একঝাঁক তরুণ তুর্কি। আর তাদের দল 'হোল নাইন ইয়ার্ডস'।
ক্যাফে থিয়েটার? অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই! হওয়ারই কথা। ক্যাফেতে যেখানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলে যায় টেবিলের চরিত্র, সেখানে ২ ঘণ্টার আস্ত একখানা নাটক হওয়ার ঘটনা তো চমকে দেওয়ারই মতো। কিন্তু গত ৩ বছর ধরে, তিরিশ-না-পেরনো এক তরুণ পরিচালক অভ্রজিৎ সেনের নেতৃত্বে এভাবেই কলকাতার দর্শককে চমকে দিচ্ছেন একদল তরুণ তরুণী। দীপ্ত দীপ, সৌম্যদীপ, তানিকা, রোশনি, সুহোত্র, অনন্যা, রায়ান, সায়ন্তন, দেবপ্রিয়, রণিতা, রোহন, উৎসব, বরুণ, পিলু। তাঁদের মধ্যে কেউ অভিনেতা, কেউ নৃত্যশিল্পী, কেউ সঙ্গীতশিল্পী, কেউ শিল্প নির্দেশক, কেউ আবার মঞ্চের নেপথ্যের কারিগর। এরা প্রত্যেকেই এই মুহূর্তে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন।
কীভাবে শুরু এই থিয়েটারের? হোল নাইন ইয়ার্ডসের কর্ণধার-পরিচালক অভ্রজিৎ সেন প্রহরকে জানালেন, '২০১৬ সালে প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার রঞ্জন পালিতের মাধ্যমে আলাপ হয় মেলবোর্নের কনি (ট্রাম কন্ডাক্টর) রবার্তো দি আন্দ্রিয়ার সঙ্গে। রবার্তো বহুদিন ধরেই কলকাতা ও মেলবোর্নে ট্রাম সচেতনতা বাড়াতে 'ট্রামযাত্রা' নামক একটি উদ্যোগ পরিচালনা করে চলেছেন। ২০১৬ সাল ছিল সেই ট্রামযাত্রার ২০তম বর্ষপূর্তি। সেই উপলক্ষেই রবার্তো হোল নাইন ইয়ার্ডসকে ট্রাম নিয়ে একটি নাটক করার প্রস্তাব দেন। মঞ্চ ও পথনাটিকার পর আমাদের হাতেখড়ি হয় ট্রাম থিয়েটারে। আমরা ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে টানা এক সপ্তাহ চলন্ত ট্রামে ও বিভিন্ন ট্রামডিপোয় নাচ, গান আর অভিনয়ের সমন্বয়ে একটি নাটক উপস্থাপন করি ও মানুষের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাই। এরপরই নাটক করার ইচ্ছে আরও বেড়ে যায়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ ও মঞ্চ অবধি এসে মানুষের নাটক দেখার অনীহা। কিন্তু সেই বাধাই আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। স্কুল জীবন থেকেই নাট্যকার বাদল সরকার আমার জীবনের অনুপ্রেরণা, আমার কাছে বাংলার নাট্যসংস্কৃতিতে অল্টারনেটিভ থিয়েটারের জনকও তিনিই। তাঁর দেখানো পথেই ক্যাফেকে থিয়েটারের জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়ার কথা মাথায় আসে। ক্যাফে থিয়েটার আমার অনুপ্রেরণা বাদল সরকারের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য বলতে পারেন।'
শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্র, বাদল সরকার থেকে শুরু করে নান্দীকার, স্বপ্নসন্ধানী। বাংলার নাট্যসংস্কৃতির গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাস বয়েছে বিভিন্ন খাতে। পাশাপাশি সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কলকাতাতেও নাটক নিয়ে একাধিক পরীক্ষামূলক কাজ হয়েছে। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের জনপ্রিয়তা বা ঐতিহ্যের পাশে দাগ কাটতে সক্ষম হয়নি। কোনো নিয়মিত অনুদান ছাড়াই ৩ বছর ধরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে কলকাতার ক্যাফে থিয়েটার। কোন যাদুবলে?
এই প্রসঙ্গে হোল নাইন ইয়ার্ডসের সঙ্গীতশিল্পী মেঘাতিথি বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বলেছেন প্রহরের সঙ্গে। সৃজনশীল ভূমিকার পাশাপাশি মেঘাতিথি দায়িত্ব নিয়েছেন জনসংযোগ, বাণিজ্যকরণ ও ব্যবস্থাপনার। তিনি জানালেন, 'শিল্প ও বাণিজ্যের মেলবন্ধনই ক্যাফে থিয়েটারকে সফল করেছে। আমরা জানতাম, ক্যাফেই এমন একটা জায়গা, যেখানে ঘণ্টাখানেক সময় কাটানোর পরিবর্তে কয়েকশো টাকা খরচ গায়ে মাখেন না আধুনিক কলকাতাবাসী। এই মনস্তত্ত্বে ভরসা রেখেই খাবার ও পানীয়ের পাশাপাশি ক্যাফেতে কাটানো সময়টুকুতে অভিনবভাবে বিনোদনকে পৌঁছে দেওয়াই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। একদিকে দর্শকদের আশাতীতভাবে নাটককে কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে ক্যাফে ও রেস্তোরাঁর ক্রমবর্ধমান বিকিকিনি - এই দুইয়ের সমন্বয়ে আজ আমরা সফল।'
২০১৭ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে হোল নাইন ইয়ার্ডসের ক্যাফে থিয়েটারের উদ্যোগ, 'টি কফি অ্যান্ড টেলস'-এর যাত্রা শুরু। 'ততদিনে ক্যাফেতে গান, কবিতার আসর বসা শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই জায়গায় নাটকের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট ও ধৈর্যশীল করে তোলার চ্যালেঞ্জ।
ক্যাফে থিয়েটারের শুরুর পথ মসৃণ ছিল না মোটেই। কিন্তু নিজেদের সৃষ্টিতে বিশ্বাস ও নাটকের প্রতি নিষ্ঠার কাছে শেষ পর্যন্ত হার মেনেছে সব বাধাই। কলকাতার বিভিন্ন নামী ক্যাফেতে ছোটো ছোটো নাটক দিয়ে যাত্রা শুরু করা ক্যাফে থিয়েটার এখন ২ ঘণ্টার পেশাদার উপস্থাপনা। যেখানে দর্শক হিসেবে সাধারণ মানুষের পাশাপাশিই দেখতে পাওয়া যায় বাংলার চলচ্চিত্র পরিচালক, কলাকুশলী, নাট্যব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতশিল্পীদের।
হোল নাইন ইয়ার্ডসের সদস্যরাই প্রহরকে জানিয়েছেন, কীভাবে দর্শকাশন থেকে উঠে এসে প্রযোজক হয়ে হোল নাইন ইয়ার্ডসের নাটকের পাশে দাঁড়িয়েছেন অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র, পরিচালক অরিন্দম শীলের মতো ব্যক্তিত্বরা। নতুন নতুন ক্যাফে থেকে শুরু করে নাটককে পৌঁছে দিয়েছেন বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের মতো অভিজাত প্রতিষ্ঠানের অন্দরে।
তবে শুধু বাঙালিরা নয়, কলকাতার এই সংস্কৃতির স্বাদ আস্বাদন করেছেন বিদেশের মানুষরাও। শহরের রুশ, ফরাসি, জার্মান দূতাবাসের কর্মকর্তারাও সাক্ষী থেকেছেন কলকাতার নবজাতক নাট্য ঘরানা 'ক্যাফে থিয়েটারের'। একাধিকবার রাশিয়ান সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড কালচার, আলিয়ঁ ফ্রাঁসে দু বেঙ্গলে, গোয়েত ইন্সটিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবনে দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে উপস্থিত হয়েছে হোল নাইন ইয়ার্ডসের নাটক। পাশাপাশি, 'ক্যাফে থিয়েটার' ঘরানা স্বীকৃতি পেয়েছে বিদেশের মাটিতেও। ২০১৯ সালে সেই স্বীকৃতিস্বরূপই কলকাতার গোয়েত ইন্সটিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবনের মনোনয়নে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উজ্জ্বল তরুণ নাট্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে জার্মানিতে 'ইম্পাল্স' থিয়েটার ফেস্টিভালে অংশ নিয়েছিলেন পরিচালক অভ্রজিৎ সেন।
আদ্যোপান্ত আধুনিক এই নাট্যদল 'হোল নাইন ইয়ার্ডস' শুধু নাটকের স্থান বেছে নেওয়া বা উপস্থাপনায় নয়, নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ক্লাসিকস নয়, ভারতের তরুণ নাট্যকারদের স্বীকৃত কাজকেই বেছে নিয়েছেন পরিচালক অভ্রজিৎ সেন। হোল নাইন ইয়ার্ডসের অন্যতম জনপ্রিয় দুটি উপস্থাপনা 'তারামণ্ডল' ও 'হার্লসডেন হাইস্ট্রিট'। এই দুটি নাটকের রচয়িতা দুই তরুণ প্রবাসী বাঙালি নাট্যকার যথাক্রমে নীল চৌধুরী ও অভিষেক মজুমদার। একদিকে, নীলের 'তারামণ্ডল' সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প 'পটলবাবু ফিল্মস্টার'কে সামনে রেখে গল্প বলে অধরা স্বপ্নের। অন্যদিকে অভিষেকের 'হার্লসডেন হাইস্ট্রিট' জানায় অভিবাসীদের ঘরে ফেরার অপেক্ষার কথা। ছোট্ট থেকে মিউজিক্যাল থিয়েটারের অনুরাগী অভ্রজিৎ-এর এই দুটি নাটকও মিউজিক্যাল। যেখানে মহীনের ঘোড়াগুলি থেকে পল ম্যাকার্টনিকে ছুঁয়ে বেলা চাও-এর হাত ধরেছে অরিজিনাল কম্পোজিশন। সৌজন্যে আরও এক তরুণ প্রতিভা দিব্যকমল মিত্র। দুটি নাটকেরই সঙ্গীত পরিচালক তিনিই।
শহর কলকাতা বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে বিনোদনের ভাষাও। আর এই বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বাংলার নাট্যসংস্কৃতিকে জাগিয়ে রাখতে লড়াই চালাচ্ছে একদল তরুণ-তরুণী। যাদের চোখে জল ঝরছে মধ্যবিত্তের অধরা স্বপ্নের শোকে, কিংবা অভিবাসীদের ঘরে ফিরতে না পারার যন্ত্রণায়। সাক্ষী হয়ে থাকছে কফির কাপে স্বস্তি খুঁজতে থাকা তিলোত্তমা।