শুধু তো কলকাতা নয়, সারা পৃথিবীই তখন একটা যুগসন্ধির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক মন্দা বাজার গ্রাস করেছে। তার সাথে দুর্ভাগ্যের দোসর হয়ে এসেছে দেশভাগ। ফিরপোজের ডান্স ফ্লোরে পা রাখলেন আরতি দাস, ওরফে মিস শেফালি। সেই গল্প তো আসলে সময়ের পিঠে চাবুক মেরে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
সমস্ত শরীরী সংকোচ উপেক্ষা করে নামমাত্র পোশাক গায়ে দিয়ে ক্যাবারে নাচের আসরে এর আগে কোনো বাঙালি মেয়ে আসেননি। স্বাভাবিকভাবেই রুচিবোধে আঘাত লাগলো আরতির স্বজাতিদের। তবে ফিরপোজ বা গ্র্যান্ডের ডান্স ফ্লোরে যারা দীর্ঘদিন বিদেশি ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ক্যাবারে দেখতে অভ্যস্ত, তাঁরা কিন্তু স্বচ্ছন্দে মেনে নিলেন আরতিকে। আর চোখেমুখে যৌবনের আবেদনে দর্শকদের মন জয় করে নিতেও দেরি করলেন না তিনি। আরতি দাস থেকে মিস শেফালি, অচিরেই হয়ে উঠলেন রাতের কলকাতার হার্ট থ্রব। কেবল তাঁকে দেখতেই রেস্টুরেন্টে ভিড় জমাতেন কত মানুষ। তারপর ক্রমশ ক্যাবারে থেকে থিয়েটার, সিনেমা, যাত্রা। মিস শেফালির হাত ধরে রাতের কলকাতার বিনোদন ছড়িয়ে পড়ল মফস্বলে। কিন্তু তারপর? আজ তাঁর মৃত্যুর পর আবার ফিরে দেখছি আমরা সেই সময়কে। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কীভাবে কেটেছে মহানগর কলকাতার এককালের রাতের রানির শেষ জীবন? তার কতটুকু খোঁজ রেখেছি আমরা?
আরও পড়ুন
সংকোচ উড়িয়ে, হয়ে উঠেছিলেন কলকাতার ‘রাতের রানি’; চলে গেলেন মিস শেফালি
দেশভাগের কিছুদিন আগে তাঁর পরিবার এপারে চলে আসে। বয়স তখন কয়েক মাস। তারপর জীবনের শুরু থেকেই দেখেছেন উদ্বাস্তু কলোনির দারিদ্র্য, বেঁচে থাকার জন্য লড়াই। বাড়িতে অসুস্থ বাবা। আর তার মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করেছেন। ষাটের দশকে হয়ে উঠেছেন ‘মিস শেফালি’। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। অর্থের অভাব ছিল না। সম্মানেরও না। কিন্তু খ্যাতির শিখরে বেশিদিন থাকতে পারলেন না তিনি। আশির দশক থেকেই কলকাতায় ক্যাবারে ডান্সের ক্ষেত্রটা ক্রমশ ছোটো হয়ে আসে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যান মিস শেফালি। তারপর আর তাঁর খবর রাখেনি বাংলার বিনোদন জগত।
গ্র্যান্ড হোটেলের কাজ তিনি স্বেচ্ছায় ছেড়েছিলেন। শরীর তখন ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। তাছাড়া ক্রমশ ক্লান্তও হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরেই আবার সেই দারিদ্রের মধ্যে এসে পড়লেন। একটু একটু করে সব সঞ্চয় শেষ হয়ে গেল। সার্কাস এভেনিউ-এর ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিলেন। ভেবেছিলেন জীবনের শেষে পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন। কিন্তু সেই রাস্তাও বন্ধ হল। সোদপুরে ভাইয়ের বাড়িতে থাকতে পারলেন না তিনি। উঠে এলেন নাগেরবাজারের কাছে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে। তবু জীবনের কাছে কোনো আক্ষেপ ছিল না তাঁর।
যখন বয়স ছিল, তখন ক্যাবারে ডান্সের সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটার-সিনেমায় অভিনয়ও করে গেছেন। শেষ জীবনে সিনেমা-সিরিয়ালে সুযোগ পেলে হয়তো কিছুটা স্বচ্ছন্দে থাকতে পারতেন। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে পরিচালক সন্দীপ রায়কে মজার ছলে সে-কথা বলেছিলেন তিনি। তবু কেমন আছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে কখনো কোনো আক্ষেপ দেখাননি তিনি। হাসিমুখে বলেছেন, "ভালোই আছি। কোনো দুঃখ নেই। ঠিক আছি।" শুধু চেয়েছিলেন কেউ তাঁকে বুঝুক। তাঁর সামান্য পোশাকের আবেদনপূর্ণ চেহারার আড়ালে যে একটা মানুষ আছে, তার জীবনের যে একটা লড়াই আছে। আর সবারই মতো প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে; সেই খবর রাখুক কেউ।
তাঁর পরিবারের মানুষরাই বোঝেননি তাঁকে। সারাজীবন খ্যাতির পাশাপাশি তাঁর দোসর হয়েছে কুৎসা, অসম্মান। বেরিয়ে আসতে হয়েছে ভাইয়ের বাড়ি থেকে। সেই বাড়িও আসলে তাঁরই রোজগারে একটু একটু করে তৈরি। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেননি শেফালি। তাঁর হাত ধরতে এগিয়ে এসেছিলেন জ্যেঠতুতো বোনের মেয়ে বুলা। তার হাত ধরেই উঠে এসেছিলেন নাগেরবাজারের ফ্ল্যাটে।
তাঁর মতোই বুলাও একজন ডান্সার। শেফালির কাছেই নাচ শিখে কেরিয়ার তৈরি করেছেন তিনি। এমনই কত মেয়েকে দীর্ঘদিন সার্কাস অ্যাভেনিউ-র বাড়িতে রেখে নাচ শিখিয়েছেন তিনি। সারাজীবন দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে বড়ো হওয়া মিস শেফালি সবসময় অন্যের প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নাহলে হয়তো শেষ জীবনে আরেকটু স্বাচ্ছল্যে কাটতে পারত। কিছুটা বেশি সঞ্চয় থাকত। কিন্তু এসব কোনোকিছু নিয়েই আক্ষেপ করেননি তিনি।
কাজ থেকে অবসর নিয়ে দীর্ঘদিন অন্তরালেই ছিলেন শেফালি। তারপর একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে আবার দেখা গেল তাঁকে। বিখ্যাত ডান্সার বব দাসের একটি সাক্ষাৎকারের অনুষ্ঠানে বব দাসের পাশেই দেখা গেল মিস শেফালিকে। বব দাসের অনুরোধ ফেলতে পারেননি তিনি। আর তারপরেই আবার তাঁকে নিয়ে খানিকটা খোঁজখবর শুরু হয়। অনেকেই জানতে চান মিস শেফালির কথা। শেফালিও চেয়েছিলেন কেউ তাঁর কথা জানুক। তাঁর জীবনের কথা শুনুক।
সারাজীবন যতটুকু ভালোবাসা পেয়েছেন, তাতেই খুশি তিনি। শুধু শেষ জীবন পর্যন্ত তাঁর একটাই আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল, তাঁর যৌবনের আবেদনকেই গোগ্রাসে গিলেছে বাঙালি। তার আড়ালে একজন স্বাবলম্বী নারীর মর্যাদা পেয়েছেন খুব কম মানুষের কাছেই। তাঁর শরীরী আহ্বানে সাড়া দিয়েছে কত পুরুষ। কিন্তু ঘর বাঁধতে পারেনি কেউ। প্রেম করেছে, স্ত্রী-র মর্যাদা দিতে চায়নি কেউই। বাঙালি পুরুষের এই ভণ্ডামির কথা বলতে বলতে তাঁর ঠোঁটের কোণে ব্যাঙ্গের হাসি ফুটে উঠত।
৭৬ বছর বয়সে, সেইসব অভিমান, অনুতাপ পেরিয়ে চলে গেলেন মিস শেফালি। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে। কিন্তু এর আগে যখন দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন, দুটো কিডনিই অকেজ অবস্থায় পড়ে ছিল; তখন তাঁর সাহায্যে কজনই বা এগিয়ে এসেছেন? মৃত্যুর কয়েকদিন আগে, এক সাংবাদিকের ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তীব্র অসুস্থ তখন তিনি। করুণ প্রার্থনা চোখেমুখে। নিজের পরিচয় দিয়ে সাহায্য চাইছেন মানুষের। ‘যদি আপনারা টাকা পাঠান, খুব উপকার হয় আমার।’ এতটাই রিক্ততায় পৌঁছেছিলেন তিনি। বারবার অনুরোধ করছিলেন, ব্যাঙ্কে টাকা পাঠানোর জন্য। কার কাছে? এই সমাজের মানুষের কাছেই। কিন্তু ক’জন সাড়া দিয়েছিলেন তাঁর সেই প্রার্থনায়?
মিস শেফালিকে এ-যুগের নটী বিনোদিনী বলেছিলেন সাহিত্যিক শঙ্কর। বিনোদিনীর মতোই একঝাঁক বিতর্ক উস্কে দিয়ে চলে গেলেন শেফালি।
তথ্যসূত্র: সন্ধ্যারাতের শেফালি, অনুলিখন – শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়