দুপুরের রোদ একটু একটু করে চড়তে শুরু করেছে। উত্তর কলকাতার গলিগুলোর ভেতর পড়তে শুরু করেছে সেই ছায়া। যতই আধুনিক হোক সময়, শহরের ভেতর আজও লুকিয়ে থাকে সেই পুরনো গন্ধ। একটা অদ্ভুত ছবি ভেসে ওঠে। শোভাবাজারের রাস্তাগুলো যখন এরকমই পুরনো-নতুনের স্বপ্ন দেখে, তখনই কথা বলা শুরু করে ছোটো ছোটো ইতিহাস। অরবিন্দ সরণি ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখনও চোখে পড়তে পারে একটি ছোট্ট দোকান। পেছনে পুরনো একটি বাড়ি; আশেপাশের সাধারণ দোকানগুলোর সঙ্গে বিশেষ তফাৎ নেই। হয়তো একবার দেখেই অনেকে চলে যাবেন। সবুজ রঙের দোকান, বাইরে নীল রঙের অতি সাধারণ একটি সাইনবোর্ড। ‘সি ব্রস’। পরিচয়ও সঙ্গে দেওয়া আছে। কিন্তু ইতিহাস কি সেখানেই থেমে যায়?
বলা হয় এই শহরের ভেতর নাকি বাস করে আরও একটা কলকাতা। সেই কলকাতার নানা রূপ। একটা কলকাতা থাকে ধুলোর চাদরের ভেতর, যাদের কথা কেউ কখনও জানতে পারে না। কিন্তু একটু ধুলো উড়িয়ে যদি দেখেন, সামনে হাজির হবে স্মৃতিদের স্লাইড। ‘সি ব্রস’ সেরকমই ভুলে যাওয়া ইতিহাসের এক সামান্য অংশ। শতাধিক পুরনো এই দোকানের সঙ্গে যুক্ত আছে কলকাতার পুরনো দিনের ফটোগ্রাফি চর্চা। আজ অবশ্য তাঁরা ছবি তোলেন না; বরং পুরনো ছবিকে ফের জাগিয়ে তোলার কাজটুকু করেন, সঙ্গে ডেভেলপও করেন। কিন্তু ইতিহাসের পথে একবার বেরোলে এই ঐতিহ্যপূর্ণ দোকানটির একেকটা রূপ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কথা বলতে বলতে সেই সবই যেন চোখের সামনে দেখতে পারছিলেন দোকানের বর্তমান মালিক সমর চ্যাটার্জি। তাঁর হাতে তখন সাদা-কালো ছবির অ্যালবাম। সঙ্গে রয়েছে নেগেটিভও; আর বহু গল্প। তাঁর ঠাকুরদার দাদা, কুঞ্জবিহারী চ্যাটার্জি দোকানটির সূচনা করেন। তবে এর পেছনেও রয়েছে ছোট্ট গল্প।
“আমার দাদুদের বাবা নারায়ণ চ্যাটার্জি বেশ অল্প বয়সেই মারা যান। তখনও ছেলেরা দাঁড়ায়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাগবাজারে কাকাদের বাড়ি চলে আসেন বড়দাদু। ছোটো থেকেই অসম্ভব প্রতিভাবান ছিলেন তিনি। একদিন এক বন্ধুকে নিয়ে ঠিক করলেন, কাছেই একজন মারা গেছেন, তাঁর ছবি তুলতে হবে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। এবার ওই সময় এরকম ভাবনা খুব কম লোকই ভাবত। এবার ডেভেলপ করাতে গিয়ে দেখেন ছবিটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে। জবাব এল, ‘মড়ার ছবি এরকমই হয়’। এবার বড়দাদু নিজের থেকেই শুরু করলেন পরীক্ষা নিরীক্ষা। এক বন্ধুর বাবা মারা যাওয়ার পর সেখানে গেলেন ছবি তুলতে। আর তখনকার দিনে সেটাই হয়তো চল ছিল। নিজেই ডেভেলপ করে দেখালেন যে মড়ার ছবি কীরকম হয়। বলতে গেলে এখান থেকেই আমাদের এই দোকানটার যাত্রা শুরু।” বলছিলেন সমরবাবু।
আরও পড়ুন
বাঙালির প্রযুক্তিতে বাজিমাত, কলকাতায় অঞ্চলভেদে দূষণের মাত্রা জানাবে নয়া যন্ত্র
সেটা ১৯১২ সাল। বাগবাজারে ফটোগ্রাফির স্টুডিওটি খুললেন কুঞ্জবিহারী চ্যাটার্জি। ঠিক কোন জায়গায় শুরু হয়েছিল জানা যায় না, তবে পরিবার সূত্রে মনে করা হয়, আজকে যেখানে বাগবাজার বাটার দোকান, তার পেছন দিকের কোনো একটা ঘরে শুরু হয় ‘সি ব্রস’-এর যাত্রা।
শোভাবাজারের অরবিন্দ সরণির আজকে যে ঠিকানায় দোকানটি, সেখানে ঢুকলেই পুরনো দিনের একটা গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা দেয়। কাচের ভেতর সাজিয়ে রাখা পুরনো আমলের তোলা ছবি। এই দোকানটির বয়সও সেঞ্চুরি পেরিয়েছে। ১৯১৬ সালে সি ব্রসের ঠিকানা বদল হয়ে যায়। তখন থেকেই ৫/সি অরবিন্দ সরণি একমাত্র আশ্রয়। এর পেছনেও রয়েছে এক অদ্ভুত গল্প। জড়িয়ে আছেন কুঞ্জবিহারীর সেজ ভাই অর্থাৎ সমরবাবুর ঠাকুরদা অনাদিভূষণ চট্টোপাধ্যায়ও। বাগবাজারের দোকানে দাদার পাশাপাশি তিনিও বসতেন। একদিন খদ্দের এসে বলছে, ‘ছবি হবে?’ অনাদিভূষণ ক্যামেরার কিছুই জানতেন না; অথচ কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিলেন। ব্যস, তাঁকে নিয়ে সোজা রওনা হওয়া ইডেন গার্ডেনসে।
আরও পড়ুন
কালীপুজোর মরশুমে বাজি কেনাবেচা নিষিদ্ধ, নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের
তেপায়া বক্স ক্যামেরা বসে আছে, এদিকে ‘ফোটো বাবু’ চুপ! এমন সময় তিনটি পায়ার একটি হঠাৎ গেল নেমে; ছবিও ফোকাসে এসে গেল। আর অনাদিবাবুও সেদিন থেকেই হয়ে গেলেন ফটোগ্রাফার। অস্থির চিত্ত কুঞ্জবিহারী চার বছর পর ব্যবসা ছেড়ে বেরিয়ে গেলে দোকান এগিয়ে নিয়ে যাবার ভার নেন অনাদিভূষণই। তখনই বাগবাজার থেকে দোকান সরে গেল শোভাবাজারে…
আরও পড়ুন
দেশের প্রথম ফটোগ্রাফিক স্টুডিও কলকাতাতেই; ১৫৩ বছরের যাত্রায় দাঁড়ি টেনেছিল অর্থাভাব
ধীরে ধীরে ব্যবসাও বেড়ে চলল। তখন বেশি স্টুডিও’র বালাই ছিল না কলকাতায়। বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড, ডি রতন, মেট্রোপলিটন— সব একটু একটু করে শুরু হয়েছে। উত্তর কলকাতায় স্থানীয় স্টুডিওগুলোর সূত্রপাত বিংশ শতকের প্রথম দিকেই। সেই যুগেরই এক উজ্জ্বল বাহক ‘সি ব্রস’। শুরুর দিকে এখানে ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে ছবিও তোলা হত। নানা জায়গা থেকে বরাত আসত কাজের, আর এখানের ফটোগ্রাফাররা চলে যেতেন ছবি তুলতে। মনে রাখতে হবে এটা সেই সময়ের কথা যখন ফিল্মের নেগেটিভ নয়, কাচের নেগেটিভ ব্যবহার করা হত। এবং সঙ্গে সঙ্গে ডেভেলপ করতে হত। নাহলেই নষ্ট হয়ে যেত নেগেটিভ। সাবধানে ব্যবহার না করলে ভেঙেও যেত অনেক সময়। ঠিক যেমনটা হয়েছিল রামকৃষ্ণদেবের ছবির ক্ষেত্রে। অতঃপর, চল্লিশের দশক থেকে একটু একটু করে ফিল্ম আসা শুরু হল। ভারতের ফটোগ্রাফি যেভাবে যেভাবে এগিয়েছে, এই দোকানগুলোও সেইসব দিনগুলোকে ধরে এগিয়ে গেছে। ইতিহাসের একের পর এক বদলের সাক্ষী থেকে যায় শতাধিক পুরনো স্টুডিওগুলো।
এতকালের পুরনো একটা দোকান, নিশ্চয়ই বহু ঐতিহাসিক ছবিও তোলা হয়েছে এখান থেকে। তার আর্কাইভাল কি আজও আছে? এখানে একটু নিরাশই হতে হবে। “আসলে এই আর্কাইভের ব্যাপারে আমার দাদু বা আমার বাবা, কাকারাও সেরকমভাবে তখন ভাবেননি। আমরাও পরে গুরুত্ব দিইনি। কাজে এটা একটা বড়ো ফাঁক রয়ে গেছে।” অকপট স্বীকারোক্তি সমরবাবুর। তবে কিছু চিহ্ন আজও রয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গেই উঠে এল গোপেশ্বর পালের নাম। একচালা থেকে পাঁচচালায় দুর্গাপূজার প্রতিমা তৈরির প্রবর্তন যে মানুষটির হাতে, যার নাম শুধু বাংলা নয়, তখন বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে, তিনি সম্পর্কে অনাদিভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু ছিলেন। দুই শিল্পীর একসঙ্গে গল্প করা, বেড়ে ওঠা— শেষে গোপেশ্বর পাল তৈরি করা প্রতিমার ছবি তুলতে লাগলেন অনাদিবাবু। তার কিছু নেগেটিভ আজও যত্নের সঙ্গে রাখা সি ব্রসে। সেই সঙ্গে আছে পুরনো কলকাতার বেশ কিছু ছবি। রয়েছে জানবাজারের রানি রাসমণির বাড়ির ছবি, পুরনো স্টার থিয়েটারের ছবি। দেখতে গেলেই হয়তো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে।
এখন আর এখানে ছবি তোলার কাজ হয় না। ১৯৮২ সালে এক খদ্দেরের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ার পর থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভেতরে ঢুকলে লাইটের মাঝে ঝুলছে একটি বাল্বটি। সেখানেও জড়িয়ে আছে ইতিহাস। বাল্বটি একসময় ছিল স্টার থিয়েটারের পুরনো ভবনে। পরে স্থান পরিবর্তন করে এখনকার জায়গায় আসার পর এই বাল্বটা নিয়ে এসেছিলেন অনাদিবাবু। আজ পুরনো ছবিকে জাগিয়ে তোলার কাজও করে সি ব্রস। সব ব্যাপারেই ইতিহাসকে যত্ন করে ধরে থাকার একটা প্রচেষ্টা। শোভাবাজারের অন্যান্য সাধারণ দোকানের ভিড়ে নিজেকে গোপন রাখতেই হয়তো ভালোবাসে দোকানের আত্মা। কিন্তু কলকাতাপ্রেমীরা এমন ইতিহাসের যাত্রীদের কি অস্বীকার করতে পারবেন কখনও!
Powered by Froala Editor