ছোট্ট ভগ্নপ্রায় ক্লাসরুম। বিদ্যুতের স্থায়ী বন্দোবস্ত নেই কোনো। জেনারেটরই ভরসা। তবু তার মধ্যেই আয়োজন করা হয়েছে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। সাদা পর্দায় ফুটে উঠছে প্রোজেক্টরের আলো। দর্শকাসনে কচিকাচাদের সঙ্গে রয়েছেন গ্রামবাসীরাও। না, ঠিক চলচ্চিত্র নয়। তথ্যচিত্র। আর সে-তথ্যচিত্রের বিষয়, আফ্রিকার অবলুপ্তপ্রায় গ্রেট এপ প্রজাতি।
দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার (Nigeria) ক্রস রিভার রাজ্যের প্রান্তিক গ্রাম বাম্বাতে, বিনোদনকে হাতিয়ার করে এভাবেই চলছে সচেতনতামূলক কর্মসূচি। সন্ধে গড়ালেই ভগ্নপ্রায় এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বসে তথ্যচিত্রের আসর। সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা হয় আফ্রিকার বিলুপ্তপ্রায় ক্রস রিভার গরিলাদের (Cross River Gorilla) জীবনযাপনের ধারা এবং তাদের ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার কারণ। তবে শুধু তথ্যচিত্র প্রদর্শনও নয়, একইসঙ্গে চলে প্রশ্ন-উত্তর পর্বও। সেই দায়িত্ব সামলান ৪৬ বছর বয়সী গবেষক লুইস কোন্যু।
আফ্রিকার বিপন্নপ্রায় গ্রেট এপ প্রজাতিগুলির তালিকায় শীর্ষেই রয়েছে ক্রস রিভার গরিলাদের নাম। যাদের মূল বসতি ছিল নাইজেরিয়ার এই রাজ্যই। তবে ক্রমশ বৃক্ষচ্ছেদন এবং চোরাশিকারীদের আগ্রাসনে আজ প্রায় বিলুপ্তির প্রহর গুনছে এই গ্রেট এপ প্রজাতি। নাইজেরিয়ার ক্রস রিভার প্রদেশে সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা এখন মাত্র ১০০। গোটা আফ্রিকায় জনসংখ্যা ৩০০-র সামান্য বেশি। নাইজেরিয়া ছাড়া একমাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র ক্যামারুনে দেখতে পাওয়া যায় এই গরিলাদের। যদিও এই পরিসংখ্যান প্রায় এক দশক আগের। ফলে, বলাই যায় বর্তমানে এই সংখ্যা কমে এসেছে আরও অনেকটা।
২০০৬ সালে গ্রেট এপ প্রজাতিটির সংরক্ষণের জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত নেয় ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি। বিস্তারিত সমীক্ষার পাশাপাশি, তৈরি করা হয় তাদের জীবনধারণের ওপর বিশেষ তথ্যচিত্র। তুলে ধরা হয় তাদের খাদ্যাভ্যাস, প্রজনন, সংরক্ষণ এবং অস্তিত্ব সংকটের মতো বিষয়গুলিকে। তবে, সেই তথ্যচিত্র দেখতে পেতেন কেবলমাত্র গবেষকরাই।
আরও পড়ুন
বিরল প্রজাতির কাছিম সংরক্ষণে অ্যাপ ওড়িশা সরকারের
২০১৪ সালে প্রথমবার নাইজেরিয়ায় গবেষণা করতে গিয়ে লুইস লক্ষ করেন, সেখানকার সাধারণ মানুষের কাছেই সম্পূর্ণ অজানা বিলুপ্তপ্রায় এই শিম্পাঞ্জিরা। এমনকি গোটা জীবদ্দশাতে একবারও এই প্রজাতিকে দেখেননি অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্করাও। ফলে, অনেক সময় স্থানীয় শিকারিরা অজ্ঞানতাতেই হত্যা করে ক্রস রিভার গরিলাদের। লুইস বুঝেছিলেন, একমাত্র স্থানীয়দের সচেতন করেই সমাধান পাওয়া যেতে পারে এই সমস্যার। তাই নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির দপ্তরে তথ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্য আবেদন করেছিলেন লুইস। শিক্ষামূলকভাবে তথ্যচিত্র ব্যবহারের অনুমতি পেতে সময় লেগেছিল কয়েক মাস। তাছাড়া প্রান্তিক গ্রামে তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজনের বন্দোবস্ত করাও ছিল বেশ কঠিন কাজ। তবে সব প্রতিকূলতাকে টপকেই, লুইসের সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান শুরু হয় বছর ছয়েক আগে। তবে শুধু বাম্বাতে নয়, বর্তমানে নাইজেরিয়ার একাধিক প্রান্তিক অঞ্চলেই চলছে এই তথ্যচিত্রের প্রদর্শন। দায়িত্ব নিয়েছে খোদ ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি। পাশাপাশি, লুইসের এই উদ্যোগ রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে ইউরোপেও। বিলুপ্তপ্রায় গ্রেট এপ প্রজাতির সংরক্ষণের মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-সহ ইউরোপিয় একাধিক সংস্থা। ক্রমবর্ধমান এই সচেতনতাই অবলুপ্তি ঠেকাবে ক্রস রিভার গরিলাদের, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশাবাদী বিজ্ঞানীমহল…
আরও পড়ুন
একঝাঁক নতুন প্রজাতির আবিষ্কার বাংলায়, জানাচ্ছে রিপোর্ট
Powered by Froala Editor