পোড়ানো হল কামসূত্র; আদৌ ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র পরিপন্থী বাৎস্যায়নের মহাগ্রন্থ?

উনিশ শতকের শেষ দিক সেটা। গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই তখন ঔপনিবেশিক শাসনের জাল বুনেছে ইংরেজরা। নিষিদ্ধ করা হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থের পাঠ। সেইসঙ্গে সমসাময়িক সাহিত্যচর্চার ওপরেও লাগু হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আইন। ঠিক এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়েই সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা ঘটিয়েছিলেন দুই ইংরেজ সাহেব— রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন এবং ফস্টার ফিটসজেরাল্ড আর্বাথনট। এই দুই সাহাবের প্রচেষ্টাতেই ১৮৭৬ সালে ইংরাজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এক প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথির। বাকিটা ইতিহাস। অল্পদিনের মধ্যেই সেই বই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল পাশ্চাত্যে। আর পরিসংখ্যানের নিরিখে আজ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বিক্রিত বই সেটিই।

হ্যাঁ, কথা হচ্ছে কামসূত্র নিয়েই। তৃতীয় থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যেই এই কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেছিলেন মহর্ষি বাৎস্যায়ন। ধর্ম এবং অর্থশাস্ত্রের পাশাপাশি মানুষের দৈনিক জীবন এবং মনস্তত্ত্বের সঙ্গে যে যৌনতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে— তা আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন বাৎস্যায়ন। আজ গোটা সমাজে যেখানে যৌনতাকে ‘আপত্তিকর শব্দ’ হিসাবে দেখা হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে এত বছর আগের লেখা এই গ্রন্থ এক কথায় বিস্ময়করই বটে। তবে কামসূত্রের পরিধি শুধুমাত্র যৌনতায় আবদ্ধ ছিল না। তাতে সাবলীলভাবেই প্রসঙ্গ এসেছে জীবনদর্শন, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা এবং ভেষজ চিকিৎসার!

সম্প্রতি, এই কালজয়ী গ্রন্থেরই সংস্করণ পোড়ানো হল গুজরাটের আহমেদাবাদে। নেপথ্য, বজরং দল। অভিযোগ, সেই গ্রন্থের পাতায় পাতায় রয়েছে নানা আপত্তিজনক ছবি। যা অবমাননা করছে হিন্দু দেব-দেবীদের। স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়, এই গ্রন্থ এবং ব্যবহৃত ছবিগুলি ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। পরবর্তীতে পুনরায় এই বই বিক্রি করা হলে, দোকানেও আগুন লাগানো হতে পারে, সেই হুমকিও দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর কর্মকর্তারা। 

তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে কোনো একটি সম্প্রদায়ের কাছে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অন্যতম মূল ভিত্তিই হল শিল্প। আর কামসূত্রের তত্ত্ব এবং দর্শন আবর্তিত হয়েছে এই জায়গাটাকেই কেন্দ্রবিন্দু করে। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে উল্লেখিত হয়েছে চৌষট্টি কলার কথা। যার মধ্যে রয়েছে সঙ্গীত, নৃত্য, দর্শন, সাহিত্য এবং অন্যান্য বিভিন্নরকম শিল্পের কথা। যৌন-লিপ্সার সমাধান নয়, বরং বাৎস্যায়ন আদর্শ মানবিক গুণাবলি এবং পরিচ্ছন্ন জীবনকেই সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এই গ্রন্থের মাধ্যমে। 

ব্রিটিশ সাহেবদের হাত ধরে পাশ্চাত্যে এই গ্রন্থ জনপ্রিয়তা পেলেও, ভারত থেকে যায় সেই তিমিরেই। আঠারো শতক পর্যন্তও যেখানে ভারতে কামশাস্ত্রের চর্চা হত, সেই ছবি বদলে যায় উনিশের মাঝামাঝি সময় থেকেই। কামসূত্রের নব্যসংস্করণ প্রকাশের পরেও ব্রিটিশ শাসকদের এড়িয়ে তা সাধারণ ভারতীয়দের হাতে এসে পৌঁছায়নি। বদলে, ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যায় ভারতের উদারনৈতিক মতাদর্শের দৃষ্টিভঙ্গি। আরও পরে ভারতের অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে জায়গা করে নেয় পাশ্চাত্যের শৃঙ্গার-রস। 

সত্তর দশকে, পাশ্চাত্যে যৌনশিল্প এবং পর্নোগ্রাফির বিকাশের পর থেকে ‘কামসূত্র’ হয়ে ওঠে কেবলমাত্র যৌনতার নির্দেশকগ্রন্থ বা ‘সেক্স ম্যানুয়াল’। পাশ্চাত্যের সেই ধারাও স্পষ্টতই প্রভাব ফেলেছিল ভারতেও। কিন্তু সেটাই কি আদি ঐতিহ্য বা মূল সংস্কৃতি এই সভ্যতার? প্রশ্ন থেকে যায়, আদৌ সংস্কৃতিরক্ষার নাম করে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বুকেই আঘাত আনতে চলছে না তো বর্তমান সমাজ? এই ধারা চলতে থাকলে কিছুদিন পর হয়তো নিষিদ্ধ করা হতে পারে গীতগোবিন্দ, গুঁড়িয়ে ফেলার প্রস্তাব উঠতে খাজুরাহো, ইলোরা কিংবা অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলিকেও। যেখানে শুধু যৌনতাই নয়, সমকামিতাকেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল পাথরের গায়ে। সেগুলিও মোটামুটিভাবে কামসূত্রেরই সমসাময়িক। আর ধর্মের কথা যদি ওঠে, তবে তো বেদ-পুরাণেও আলোচিত হয়েছে কামরসের কথা। এসবের পরেও ধর্মরক্ষার মেকি অজুহাত যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে উল্টোস্রোতে ভাসছি আমরা, প্রত্যাবর্তন করছি মধ্যযুগীয় মানসিকতাতেই। এর শেষ কোথায়, জানা নেই…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More