গানে, গল্পে বুলবুলিকে সবসময় ‘গান গাওয়া পাখি’ হিসেবেই চিনতে শিখেছে বাংলা। সলিল চৌধুরীর সুরে, অন্তরা চৌধুরীর গলায় সেই গানটির কথা মনে পড়ে? ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে/ আয় না যা না গান শুনিয়ে’। কলকাতার দিকে নজর দিলে আজ কদাচিৎ দেখা মেলে এই পাখির। দূষণ এবং নগরোন্নয়ন ক্রমশ কেড়ে নিচ্ছে তাদের মুক্তির আনন্দ। একটা সময় ছবিটা তো এমন ছিল না। কলকাতা তখন এত হাইরাইজ দেখেনি। বরং দেখেছে অসংখ্য বাগানবাড়ি, ইংরেজ মহল আর বাবু সম্প্রদায়ের বিলাস। সেই বিলাসেরই একটি অঙ্গ ছিল ‘বুলবুলি লড়াই’।
ইতিহাস বড়ো অদ্ভুত জিনিস। নানা সময় নানা প্রতিচ্ছবি নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। হয়তো সামনেই রয়েছে, কিন্তু হাতে ধরে দেখাতে পাচ্ছেন না কেউ। ইতিহাসের বইতে কত যুদ্ধের কাহিনি উঠে এসেছে। কখনও দেশীয় রাজা-রাজড়াদের যুদ্ধ, কখনও দেশের মধ্যে যুদ্ধ; আবার কখনও সেটা বদলে যায় স্বাধীনতার লড়াইয়ে। এই ঝড় বয়ে গেছে কলকাতার ওপর দিয়েও। তবে সব যুদ্ধই কি মানুষে-মানুষে হয়? তা তো নয়! অদ্ভুত লাগলেও, লড়াই সমাজের এক অংশের কাছে বিনোদনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। আর সেই ‘আনন্দ’ই রয়ে গিয়েছিল পুরনো কলকাতার ভেতর। আজও বাংলার গ্রাম-গঞ্জের মানুষ মেতে উঠত মোরগের লড়াইয়ে। কলকাতা যত আধুনিক হয়েছে, শহরের বুক থেকে এসব বিদায় নিয়েছে। কিন্তু স্মৃতির পথ ধরে এসে যায় এরকমই এক অদ্ভুত লড়াইয়ের কথা— যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বুলবুলি পাখি ও কলকাতার বাবুসমাজ।
ঠিক কবে এর শুরুয়াৎ, জানা যায় না। তবে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সম্ভবত মুঘলদের হাত ধরে এই লড়াই ভারতে প্রবেশ করে। ইরান, ইরাক, আফগানিস্থানের কিছু জায়গায় আজও বুলবুলির লড়াই চালু আছে। প্রাচীনকালেও সেখান থেকেই এদেশে আগমন ঘটেছিল এর, এমনটাই ধারণা। মুঘলদের থেকে বাংলার নবাবদের হাত ধরে এই খেলার প্রবেশ ঘটে এখানে। মূলত বড়োলোক ও নবাবদের বিনোদন হিসেবেই এর প্রচলন ছিল। ধীরে ধীরে কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। সেই সুযোগে টাকা করতে থাকে এক শ্রেণীর মানুষ। তাঁরাই হয়ে ওঠেন কলকাতার ‘বাবু’। কলকাতার নানা জায়গায় এই বাবুদের বিশাল বাড়ি ও বাহারের জীবন চর্চায় উঠে আসে। এবং সেখানে একটা সময় প্রবেশ করে বুলবুলির লড়াই।
প্রধানত তিন প্রজাতির বুলবুলি পাখি দেখা যেত সেই সময়— লাল, শা আর সিপাহী বুলবুলি। এদের মধ্যে সিপাহী বুলবুলিরাই অংশ নিত লড়াইয়ে। খয়েরি আর সাদা পালকে ঢাকা শরীর, মাথার দিকটার রং টকটকে লাল; সবশেষে মাথায় থাকত কালো ঝুঁটি। চেহারাটাই ছিল রাজকীয়। একেবারে খাঁটি সৈনিক বলে কথা, চেহারা না থাকলে হয় নাকি! এদেরকে প্রশিক্ষণ যারা দিত, তাঁদের বলা হত খলিফা। কখনও খোলা মাঠে, কখনও লোহার জালের ভেতর নিজেদের সিপাহী বুলবুলিদের ছেড়ে দিত বাবুরা। তারপর আমোদ চলত। পাখিরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করত; আর সেসব দেখার জন্য ভিড় জমত চারদিকে।
রামদুলাল দে সরকারের দুই ছেলে আশুতোষ ও প্রমথনাথ কলকাতার বাবু সমাজের অন্যতম অংশ হয়ে উঠেছিলেন। এই নামে ইতিহাস তাঁদের চেনে না। কালে কালে আশুতোষের পরিচয় হয় ছাতুবাবু নামে; আর ভাই প্রমথ লাটুবাবু। কলকাতার গল্পে নানাভাবে উঠে আসেন এই দুজন। নানা দান ধ্যান করেছেন একসময়। এই ছাতুবাবু-লাটুবাবুই প্রসিদ্ধ ছিলেন বুলবুলির লড়াইয়ের জন্য। আজ যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার, সেখানেই আগে ছিল ছাতুবাবুর মাঠ। সেখানেই শীতকালে বড়ো করে বসত বুলবুলির লড়াইয়ের আসর। আশেপাশের মানুষরা এসে ভিড় জমাত মাঠে। নানা উল্লেখযোগ্য ‘লড়াই’য়ের সাক্ষী থেকেছে এই মাঠ। ছাতুবাবুদের সঙ্গে কখনও হরনাথ মল্লিক, কখনও নরসিংহ রায়, দয়ালচাঁদ মিত্রের লড়াই হত। সকাল সকাল শুরু হয়ে যেত লড়াই। কোনো কোনো সময় খেলা চলত প্রায় বিকেল পর্যন্ত। এতটাই জনপ্রিয় ছিল এই বিনোদন…
আজ কলকাতার বুকে বুলবুলির লড়াই দেখা যায় না। কিন্তু বাংলার জঙ্গলমহল, ঝাড়গ্রামে আজও লড়াইয়ের আসর বসে। মকর সংক্রান্তির দিনে মোলাকাত হয় পাখিদের। এইভাবেই টুকরো টুকরোভাবে জিইয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্য। তবে বুলবুলিদের যে রক্ষাও করা দরকার!
আরও পড়ুন
‘মুসলমানদের ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না’; যে সামাজিক ব্যাধি গ্রাস করছে কলকাতাকেও
তথ্যসূত্র—
১) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ / শিবনাথ শাস্ত্রী
২) কলকাতা বিচিত্রা/ রাধারমণ রায়
আরও পড়ুন
মানুষের হাড় দিয়েই তাক-লাগানো ভেল্কি, কলকাতা ভুলেছে মাদারি জাদুকর রহমতুল্লাকেও
Powered by Froala Editor