কোনো বই হু-হু করে বিক্রি হচ্ছে শুনলে আনন্দ হয়। তাও কিনা পুজোর সময়ে, যখন সকলে উৎসবে মশগুল। কিন্তু লেখকের নাম যদি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হয়, তবে তা সম্ভব। দিন দুয়েক তল্লাশের পর তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বইখানা যখন হাতে এল, স্টলের প্রবীণ কর্মী হেসে বললেন, ‘এই বইটা জানো তো যাকে বলে হট কেক।’
তো সেই হট কেক – ‘স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা’ – ঠান্ডা না করে পড়া শুরু করা গেল। এবং, বই শেষও হয়ে গেল অচিরেই। আগুপিছু উলটে প্রাথমিকভাবে মনে হল, হলটা কী! বেশ যেন ধোঁয়াশা। ফলত দ্বিতীয় পাঠ। বস্তুত দ্বিতীয় পাঠেই খানিকটা ধরা পড়ে, কী অভিপ্রায় লেখকের তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর।
না, এই পাঠ-প্রতিক্রিয়া থেকে প্রথমেই ঝেড়ে ফেলতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পরিচয়টিকে। বরং তাঁকে যদি একজন একনিষ্ঠ, অভিজ্ঞ, প্রবীণ এবং এ-রাজ্যে বর্তমানে সর্বাধিক মান্য বামকর্মী হিসেবে দেখি, তবে দেখব, যে-তরুণ কর্মী কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তর সঙ্গে প্রথমবার চিনে গিয়েছিলেন, তিনি এই জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে যেন খানিকটা পুনর্মূল্যায়নেই বসেছেন। অথবা, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে মিলিয়ে নিচ্ছেন তাঁর পূর্বাপর ভাবনাগুলোকে। এবং কী হতে পারে ভবিষ্যৎ, সেই সম্পর্কে তাঁর চিন্তাগুলোও আলগা করে এলোমেলোভাবে বলে রাখছেন। তবে সবথেকে বড়ো কথা, সংশয় প্রকাশ করছেন। চিনের বিস্ময়কর সাফল্যের মধ্যেও তিনি কয়েকটা প্রশ্নচিহ্ন তুলে রেখে দিচ্ছেন, যা সর্বার্থে জরুরি।
চিন নিয়ে একটা হায়-হায় লক্ষ করা যায় এক শ্রেণির বাঙালির মধ্যে। অর্থাৎ, কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম। আবার, আর-এক শ্রেণির বাঙালি চিনকে ঈশ্বরপ্রতিম মনে করেন। তাঁদের ধারণা চিনের পথেই আমাদেরও মুক্তি, ভাবখানা এরকম- আজ কোথায় পৌঁছে গেছে চিন! আর, আমাদের এখানে বাম ভাবধারা পত্র-পুষ্পে বিকাশলাভের পরও আমাদের কী দুরবস্থা! কোনটি প্রকৃত হাহাকার এখানে, তা শনাক্ত করা বেশ মুশকিল। তবে, চিনের ইতিহাস শিশুপাঠ্যের মতো করে বোঝাতে-বোঝাতে আফিম যুদ্ধ, কমিউন, মাও জে দঙ, গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড পেরিয়ে বুদ্ধবাবু যখন দেঙ জিয়াও পিং-এ পৌঁছালেন তখন আয়নাটা খানিক দেখা গেল। এই দেঙ-এর দেশের বাড়িতে গিয়ে লেখক শুনেছিলেন, বেড়াল যে-রঙেরই হোক না কেন, ইঁদুর ধরার জন্য তাকে জরুরি। যে-ইঁদুর ফসল নষ্ট করে, তাকে মারতে, বেড়াল সাদা কি কালো তা নিয়ে চিন্তা করলে চলে না। দেঙ-এর চিন্তাধারা চিনকে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিল – ‘কৃষিতে ব্যক্তি ও পরিবারের ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করায় কৃষিতে আরেক দফা সাফল্য আসে। জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা এখন নিম্নগামী। সেটাই বাঞ্ছনীয়। শিল্প পরিষেবা (ইন্ডাস্ট্রিয়াল সার্ভিসেস) মুখ্য ভূমিকা নেবে এবং নিচ্ছে।’ চকিতে মনে পড়ে যায় ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগানটিকে, খেয়াল হয় কিছুটা আগেই লেখা তাঁর লাইনগুলো, ‘বাজারের অর্থ কি? বাজার মানেই পুঁজিবাদ নয়। বাজার সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দুইয়েরই কাজে আসতে পারে। পুঁজিবাদী উৎপাদনের কিছু কিছু সাফল্য, কিছু উৎপাদন ব্যবস্থা বা পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য। পাশাপাশি সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি পুঁজির ভূমিকাও থাকবে। সরকারের লক্ষ্য দুইয়েরই উন্নয়ন। বাজার যেভাবে চাইবে সেভাবে এগোবে। শেষ পর্যন্ত কর্তৃত্ব থাকবে সরকারের হাতে।’ ভাবনাটিকে প্রয়োগের দিক থেকে খুব চেনা মনে হয়, যদিও এই আলোচনার পরিসর আপাতত সরিয়ে রাখাই হল। কারণ, এখানে অনেক জরুরি একজন অভিজ্ঞ বামকর্মীর আত্মদর্শন তথা তাঁর চোখে ইতিহাসের পর্যালোচনা। চিনের অভাবনীয় সাফল্যের মাইলস্টোন থেকেই লেখক একে একে দেখাতে থাকলেন কলঙ্কের চিহ্নগুলোকেও - চিনের দারিদ্র্য, অল্পবয়সি মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তিতে নামা, ইগালিটারিয়ানিজমের অভিশাপ, শহর গড়তে নতুন করে মানুষের বাস্তুহারা হওয়ার ভবিতব্য এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়া। ঝাঁ-চকচকে চিন, আকাশচুম্বী সাফল্যের চিনের কাছেও যে রক্ষাকবচ এখনও করায়ত্ত নয়। লেখক বলছেন, চিনা সাধারণতন্ত্রকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে।
আর, আমাদের?
লেখক নিরুত্তর। বা তাঁর উত্তর, ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে।’
কিন্তু এ কি তবে এড়িয়ে যাওয়া? সম্ভবত নয়। উত্তর, একমাত্র আত্মসমালোচনা। ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে নিজেদের ফেলে ফেলে দেখে নেওয়া কোনটা ভুল, কোনটা করা উচিত ছিল। আর, কোনটা গর্হিত। সম্ভবত এলেমেলো স্মৃতির ভিতর থেকে তরুণদের, এ-রাজ্যের চিন্তাশীল তরুণ প্রজন্মকে সেই বার্তাই দিতে চাইলেন বুদ্ধবাবু। ভূমিকার যে-অংশটি বইয়ের ব্লার্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা এখানে প্রণিধানযোগ্য, ‘কোনও চরিত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে আমি দাঁড়াইনি। যে বিষয়টি বাস্তবে প্রমাণিত সেটিই সত্য, শুধু তত্ত্বে নয় – এই মার্কসিয় ধারণাকেই আমি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছি।’
অর্থাৎ, তত্ত্বের সত্যি শুধু নয়, বাস্তবের সত্যিই প্রকৃত শিক্ষক। বাস্তবের কিছু অংশ লুকিয়ে বা অস্বীকার করে, বাস্তবের সত্যির সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে সমাজতন্ত্র কেন, কোথাও পৌঁছানো যায় না। তাই সত্যিতে ফিরতে-ই হবে। সে-সত্যি যদি জনবিচ্ছিন্নতা হয়, ভোগবিলাসের পাপ হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার হয়, তবে তাই-ই। তবু তাকে অস্বীকার করে আদপেই কিছু হয় না। বরং স্বীকার করলে একটা-না-একটা পথ মেলে। শস্য নষ্টকারী ইঁদুর মারা জরুরি বটে, বেড়াল ডাকাও তত্ত্বগতভাবে ঠিক, তবে বাস্তব কী বলে, যে-কোনো রঙের বেড়ালকেই তার জন্য ডাকা যায়? সেই ডাকের জেরে মানবাধিকার ফুরিয়ে এলে কী করণীয়! গোধূলিবেলায় প্রকারন্তরে এই বিবেচনার ক্ষমতা এবং সেই হেতু পাওয়া সত্যের পথটাই হয়তো ধরিয়ে দিতে চাইলেন বুদ্ধবাবু।