১৯৯৭-এর কলকাতা বইমেলা। ২৭ বছর পেরিয়ে, বেশিরভাগ বাঙালি সে-মেলাকে মনে রেখেছে অগ্নিকাণ্ডের কারণেই। এ-তথ্য প্রায়-অচর্চিত যে, সেই বইমেলাতেই আরও অসংখ্য বইয়ের পাশাপাশি বেরিয়েছিল একটি প্রবন্ধগ্রন্থও। নাম, ‘হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর’। লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য— বাহ্যিক পরিচয়ে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হলেও, ভেতরে-ভেতরে যিনি একজন কবি, প্রাবন্ধিক, ভাবুক ও সংস্কৃতিপ্রেমী। বইটিতে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে নিজের পাঠ ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। কিন্তু কেন? তার জবাব ভূমিকাতে লিখেছেন নিজেই— ‘আমার এই বই লেখার উদ্যোগ খানিকটা অবদমিত ইচ্ছার আত্মপ্রকাশ।’
পত্রভারতী কর্তৃক প্রকাশিত সে-বইয়ের উৎসর্গেও ছিল জীবনানন্দের কবিতার লাইনই— ‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে/ তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়’। কবির দর্শন ও আলোচকের দর্শন এক থাকে না বহুক্ষেত্রেই। বুদ্ধদেবের কাছে এই ‘তুমি’-টি কে? মানুষ, কবিতা, বামপন্থা নাকি খোদ জীবনানন্দই? আমরা তা জানি না। তবে পাঠক হিসেবে জীবনানন্দের কবিতায় বুঁদ ছিলেন তিনি, তা স্পষ্ট। ভূমিকার শুরুও ইঙ্গিত করে সেদিকেই— ‘আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, চিন্তা করি, হতাশায় স্বপ্নে বিমর্ষ বিভোর হই, জীবনানন্দ দাশের অদম্য অলৌকিক আকর্ষণ তাঁদের আলেয়ার মতন ডেকে নিয়ে যায়।’ নামকরণ থেকে উৎসর্গ— সবেতেই জীবনানন্দ-স্পর্শ সেই আবিষ্টতার সাক্ষী। ‘বুনো হাঁস’ কবিতার শেষ লাইন ‘উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর’-এর অংশবিশেষ নামকরণের জন্য বেছে নিয়ে তা আরও ব্যঞ্জনাবাহী করে তুলেছেন বুদ্ধদেব; কিন্তু অনুচ্চারিত ‘উড়ুক উড়ুক তারা’-র মধ্যে যে মুক্তির কাঙ্ক্ষা, তা কি তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষার ফসলও নয়?
চার ফর্মার বইটি ছোটো-বড়ো কয়েকটি পর্বে ভাগ করা। প্রথম পর্বের শিরোনাম ‘কবিতা অনেক রকম’। এখানে কবিতার সংজ্ঞা-অনুসন্ধানী তিনি। তবে এ-ও জানাচ্ছেন, ‘কবিতার সংজ্ঞা আজও কবিতা মতই কুজ্ঝটিকা-ভরা। কাব্য ও নন্দনতত্ত্বের ইতিহাসে কবিতার সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা কোনোদিনই ছিল না, কোনোদিনই কি হবে?’ তাঁর মতে ঘুম-পাড়ানো গান, ছড়া, সূর্যস্তুতি কিংবা মহাকাব্য— কবিতা হিসেবে পরিচিত হতে পারে সবই। এরপরই অমোঘ কয়েকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন বুদ্ধদেব— ‘কবিতা কি Criticism of Life? জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা? জীবন জিজ্ঞাসা? জীবন দর্শন?’ এই পর্যায়ে তাঁর পাঠবিস্তৃতির মুখোমুখি হয়ে বিস্মিত হতে হয়। কবিতার বৈচিত্র্য-প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে দেশ-বিদেশের সাহিত্যে অনায়াসে বিচরণ করেছেন তিনি। সেখানে উদাহরণ হিসেবে যেমন উঠেছে বৈষ্ণব পদাবলি, ময়মনসিংহ গীতিকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কথা; তেমনি মায়কোভস্কি, ইয়েটস, কিটস, কোলরিজ, নেরুদা, ডে লুইস, লোরকা, রিলকে, পল এল্যুয়ের, গুন্টার গ্রাস কিংবা বোদলেয়ারও বাদ পড়েননি তাঁর সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে। কবিতার পরিচিতি খুঁজতে গিয়ে এই বিশ্বভ্রমণ শুধু লেখকেরই নয়, আড়ালে লুকিয়ে-থাকা এক ‘প্রস্তুত’ পাঠকেরও বটে; জীবনানন্দ-তীরে নোঙর ফেলার আগে যিনি ছুঁয়ে এলেন পূর্বসূরিদের পথটুকু।
জীবনানন্দের কবিতার আত্মগত দিকটিতেই বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন বুদ্ধদেব। সেই সূত্রে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নিজস্ব কবিতাদর্শনও। তাঁর মতে, ‘চিন্তা, বিজ্ঞান, মতবাদের কঙ্কালই কবিতা নয়। তার ওপর কল্পনার আলো ও আবেগ তাকে দেহদান করে। সেই দেহেই রয়েছে কবিতার সবল মাধুর্য।’ এই ভাবনার আলোকেই জীবনানন্দকে ধরতে চেয়েছেন তিনি। যে-কারণে অন্যান্য কয়েকজন গবেষক যখন জীবনানন্দের কবিতার ব্যবচ্ছেদ করে মূল উৎসের কাছাকাছি পৌঁছোতে চান, বুদ্ধদেব তার রহস্যময়তাকে অটুট রাখার পক্ষপাতী। কবিতাকে শুধুমাত্র কবিতা হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যে যে দিগন্তবিস্তৃত সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়ে থাকে, ব্যবচ্ছেদ সততই তা রুদ্ধ করে দেয়। আবার এই রহস্যময়তার জন্যেই গণপাঠক যে তাঁর কবিতার রসগ্রাহী হবে না, এ-কথা জীবনানন্দও বুঝতে পেরেছিলেন— তা উল্লেখ করতে ভোলেন না বুদ্ধদেব।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষিত বামপন্থী। বইটি যখন প্রকাশিত হচ্ছে, রাজ্যের প্রধান শাসকদল সিপিআই(এম)-এর অন্যতম নেতা তিনি। জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে ব্যাখ্যার সময়, বামপন্থী পরিবেশ ও আন্দোলন থেকে কবির দূরত্বও চোখ এড়ায় না তাঁর। জীবনানন্দের সমকালীন কবিদের কারো-কারো কবিতায় বাম চেতনার ছাপ যখন প্রবল (বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা উদ্ধৃত করেছেন বুদ্ধদেব), ‘জীবনানন্দ একাকী, নিজের মধ্যেই পথ খুঁজেছেন। কোনো মঞ্চে, কোনো শিবিরে, কোনো মিছিলে পা দেননি।’ এমনকি তিরিশ-চল্লিশের দশকের একের পর এক ঘটনাপ্রবাহে সমাজ যখন উত্তাল, বুদ্ধদেবের বিশ্লেষণে ‘জীবনানন্দের চেতনা প্রবাহ সত্যিই বিস্ময়কর অন্তর্মুখী।’ অথচ এই প্রবণতাকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেন না তিনি, বরং সাময়িকতা ও তাৎক্ষণিকতাকে অতিক্রম করে ‘শাশ্বত মীমাংসা’-র সন্ধানপ্রয়াসী কবির প্রতি সম্ভ্রমই জাগে তাঁর।
বুদ্ধদেব মনে করিয়ে দেন, ‘মার্কসীয় চিন্তায় শ্রেণীবিভাগ ও বৈষম্যই বিচ্ছিন্নতার উৎস। শ্রেণীশাসনের অবসানে এ্যালিনিয়েশন থেকে ইন্টিগ্রেশনেই মানবমুক্তি।’ অথচ এর ঠিক বিপরীতে অবস্থান করেন জীবনানন্দ; ‘তাঁর ব্যক্তিত্বের মূল কাঠামোর একাকিত্ব, তজ্জনিত অস্থিরতা ও মৃত্যুচিন্তা তাঁর জীবনদর্শনের একটি ধ্রুবপদের মতন বারবার মুখ দেখিয়েছে।’ সে-কারণেই ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা-কেন্দ্রিক আলোচনায় বুদ্ধদেব অনায়াসে প্রশ্ন তোলেন— ‘এ কি অস্তিত্ববাদের প্রতিচ্ছায়া নাকি দুঃসময়ের আত্মিক সংকট?’ লিখিত হয় এক অমোঘ বাক্য, যা জীবনানন্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচনা হিসেবে গণ্য হতে পারে— ‘বাংলা কবিতাকে এই মর্গের পথে আগে কেউ নিয়ে হাঁটাননি।’ পাশাপাশি, তুলনা টানেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র সঙ্গেও। বুদ্ধদেবের মতে, জীবনানন্দের কবিতায় যে ‘বিপন্ন বিস্ময়’, তার সঙ্গে তুলনীয় শশী ডাক্তারের ছাইগাদার ওপর উঠে সূর্যাস্ত দর্শনকালীন বিস্ময়।
জীবনানন্দ-চর্চায় বুদ্ধদেব আদতে বাহ্যিক আড়ম্বর সরিয়ে কবিতার অন্তর্গত মনোজগতের সন্ধানে ব্রতী। একজন ব্যক্তি, যিনি কিনা কবি— তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কবিতার শরীরে কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে, টালমাটাল পথে ও জীবনে হাঁটতে হাঁটতেও কবিতায় কীভাবে শাশ্বত সত্যের সন্ধানী তিনি— এ-ই বুদ্ধদেবের জীবনানন্দ-খোঁজ। তাঁর সমস্ত ধারণা ও ব্যাখ্যা যে অভ্রান্ত, সে-অহং নেই লেখকের। বরং ভূমিকায় অকপটে লিখে রাখেন— ‘যদি অজ্ঞান, অসতর্ক ও অন্যমনস্কতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হই, তবে ক্ষমাপ্রার্থী পাঠকের কাছে, সর্বোপরি জীবনানন্দ দাশের কাছে।’ তবে সবকিছু পেরিয়েও, সামাজিক চাপানউতোর ও দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন থেকে কবিতাকে খানিক দূরত্বে রাখার যে-প্রয়াস জীবনানন্দ নিয়েছিলেন, তা কি ‘রাজনীতিক’ বুদ্ধদেবকেও প্রভাবিত করেনি খানিকটা? শাসক দলের মন্ত্রিত্বের মতো গুরুদায়িত্ব দীর্ঘদিন সামলেও নিজের লেখালিখি ও সাহিত্যচর্চা অক্ষুণ্ণ রাখার যে-মন, সেটিকে নষ্ট হতে দেননি তিনি। বরং এই সাহিত্যচর্চার নিভৃতিটুকুকেই একান্ত করে পেতে চেয়েছেন— লেখক হিসেবে, পাঠক হিসেবে। ঠিক যেমন জীবনানন্দ, দিনশেষে আঁকড়ে ধরেছিলেন কবিতাকেই…
এই বই যখন প্রকাশিত হচ্ছে (১৯৯৭), তখন বুদ্ধদেবের ৫৩ বছর বয়স। মৃত্যুকালে জীবনানন্দের বয়স ছিল ৫৫। জীবনানন্দের কাছাকাছি বয়সে পৌঁছে, কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁকে যথাসম্ভব চিনতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কবির মৃত্যু সম্পর্কে তিনি লেখেন— ‘দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুও তাঁর সৃষ্ট কবিতার মায়ালোকের মতোই রহস্যাবৃত।’ ‘মহাপৃথিবীতে’ কবিতায় ট্রাম-প্রসঙ্গের ভেতরে খোঁজেন মৃত্যুর আভাস। অথচ, তারপরও মৃত্যুর থেকে বড়ো হয়ে ওঠে শিল্পই। বইয়ের শেষ লাইনগুলিতে, সে-কথাই মনে করিয়ে দেন তিনি— ‘মানুষ মরণশীল। ক্ষণস্থায়ী জীবনে কবিরও মৃত্যু হয়। শুধু থাকে তাঁর কবিতা। আত্মজ পাণ্ডুলিপি উড়ে চলে অনন্তকালের কাছে, ব্যাকুল প্রতীক্ষায়, বিচার প্রার্থনায়।’ শুধু জীবনানন্দ-প্রসঙ্গে নয়, যে-কোনো কালে, যে-কোনো কবির ক্ষেত্রেই এ-কথা সত্য—বুদ্ধদেব তা জানতেন।
মূল পরিচয় রাজনীতি-কেন্দ্রিক হলেও, প্রাবন্ধিক হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুনশিয়ানা ফুটে ওঠে বইটির ছত্রে-ছত্রে। তবে একটি বই নির্মাণের ক্ষেত্রে, লেখার বাইরেও জড়িয়ে থাকে আরও অজস্র স্তর। অজানা সেই অধ্যায় জানতেই যোগাযোগ করেছিলাম বইটির প্রকাশক তথা পত্রভারতী-র কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯৯৬-এ অংশু সুর মারফত পত্রভারতী থেকে বইটি প্রকাশের ইচ্ছা জানান বুদ্ধদেব। তারপর, সে-বছরের নভেম্বর থেকে শুরু হয় কাজ। একবারে নয়, খেপে-খেপে সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিটি পাঠান তিনি। লেখক হিসেবে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন বুদ্ধদেব, একাধিক সংযোজন-বিয়োজন করেছেন পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার পরেও— জানিয়েছেন প্রকাশক। প্রচ্ছদ করেন হিরণ মিত্র, লেখকের ইচ্ছানুসারেই। তারপর, ’৯৭-এর বইমেলার শুরুর দিনে তাঁর হাতে বইটি তুলে দেন ত্রিদিব।
“জীবনানন্দ কবি হিসেবে তাঁর সময়ের কাছে ‘দায়বদ্ধ’ ছিলেন কিনা, ‘সৎ’ ছিলেন কিনা— এই মূল্যায়ন কখনই চূড়ান্ত হবে কি না জানি না। তবুও মনে হয় শুধু ক্লীবত্বের সান্ত্বনা দিয়ে তিনি পলাতক, তিমির বিলাসী নন।”— লিখেছিলেন বুদ্ধদেব। তাঁর জীবনানন্দ-পাঠ সর্বার্থেই আলাদা। কবিতা-বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে সময়, সংগ্রাম, মনস্তত্ত্ব ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। খোলা মনে আলোচনা করেছিলেন জীবনানন্দের সীমাবদ্ধতা ও বিস্তার নিয়ে। তবে সীমাবদ্ধতা বিষয়টি যে আপেক্ষিক, কবির অন্তর্জগত যে ভিন্ন কোনো অসীমের দিকে ধাবমান— এই সত্য উপলব্ধিতেও ত্রুটি ঘটেনি তাঁর। লেখক হিসেবে তো বটেই, পাঠক ও সর্বোপরি বিশ্লেষক হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে চিনতে সাহায্য করে এই বই। ভাষাচর্চার প্রতি তিনি যে ‘দায়বদ্ধ’ ও ‘সৎ’— এ-বিষয়ে কোনো সংশয়ই থাকে না তখন আর…
Powered by Froala Editor