মায়ের মৃতদেহের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন বাবা, বুদ্ধদেব বসুর কাছে মাতৃস্মৃতি ওটুকুই

এ-পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ নামে একজন মানুষ ছিলেন এবং তিনি বাঙালি। কেবল তথ্য হিসেবে নয়, অস্তিত্বের মর্মমূলে এ-কথা বসিয়ে নিলে, রবীন্দ্রোত্তর যুগে যে আধুনিক বাঙালির জন্ম-সম্ভাবনা বাস্তব হয়ে ওঠে, অত্যুক্তি হবে না, যদি বলি, তাঁর নাম বুদ্ধদেব বসু। যাপনে-মননে এমন ঋদ্ধ আধুনিক মানুষ বিরল শুধু নয়, বুদ্ধদেব নিজেই এক কম্পার্টমেন্ট, উত্তরকালের বাঙালি বারবার যার অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছে। অন্তত চেষ্টা করেছে, বলাই যায়।

আমরা বুদ্ধদেবকে দেখিনি। আবার, যাঁরা তাঁর রচনার নিয়মিত পাঠক, তাঁরা যে বুদ্ধদেবকে দেখেননি, জোর দিয়ে এমন কথা বলা যায় না। আমরা কল্পনা করতে পারি যে, সকালে উঠে টেবিলে বসে জরুরি কোনও প্রবন্ধ লিখছেন বুদ্ধদেব। প্রতিভা বসু ব্যস্ত সংসারের কাজে। তিনিও লেখেন। লেখেন মানে, স্মরণীয় সব লেখাই লেখেন। চলচ্চিত্র জগতের কাছে প্রত্যেকটা উপন্যাসের ব্যাপক কদর ও চাহিদা। কিন্তু তিনি কখন যে লেখেন, কেউ জানে না। বাঙালি ঘরে সংসারের দায়িত্ব সামলানোর ঝক্কি আর পাঁচজন গৃহবধূর মতো প্রতিভাও কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। স্বামীর লেখার ক্ষতি হতে দেননি, সংসারে খামতি রাখেননি, আবার নিজের লেখা থেকে সরেও আসেননি। আমরা প্রতিভার সূত্রেই ঢুকে পড়ব বুদ্ধদেবের বিস্ময় জগতে। আমার মনে হয়, বুদ্ধদেবকে চিনে নিতে গেলে রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, ব্যোদলেয়ার প্রমুখ মহাজনদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তাঁর জীবনের সঙ্গে সংলগ্ন কয়েকজন নারীর ভূমিকা।

অথচ এই প্রতিভাকে বিয়ে করার সময়, মাতাল বদনামও জুটেছিল বুদ্ধদেবের কপালে। তখন রানু সোম নামে পরিচিত প্রতিভা। লেখক হিসেবে বুদ্ধদেব যতটা নাম করেছেন, সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিভাও ততখানি। যদিও বুদ্ধদেবের সুখ্যাতির সঙ্গে অখ্যাতিই জুটেছিল বলা যায়। প্রথম গল্প ও উপন্যাস থেকেই তাঁকে পড়তে হয় অশ্লীলতার দায়ে। শোনা যায়, কোনও সমালোচক এমনও বলেছিলেন যে, হয় এই লেখকের বিয়ে দেওয়া হোক, নয় বউ বাপের বাড়ি গেলে শিগগির ফিরিয়ে আনা হোক তাঁকে। বুদ্ধদেব বিচলিত হননি। বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় যোগ, তাঁকে ঠিক রাস্তাই দেখিয়েছিল। বুদ্ধদেবের সাহিত্যবোধ তাঁকে সর্বার্থে আধুনিক হিসেবেই গড়ে তুলেছিল। সেখানে কোনও রক্ষণশীলতার জায়গাই নেই। আর এই অশ্লীলতার দায় তো একবার নয়। জীবনে বারবার জুটেছে। সমরেশ বসুর ঘাড়ে যখন এই দায় এসে চাপল, তখন আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। সঙ্গে ছিলেন নরেশ গুহ। উকিলের বারংবার জেরার মুখে বুদ্ধদেব প্রত্যয়ী সুরে একটি কথাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে, সমরেশের লেখায় অশ্লীলতার কোনও ছাপ তিনি দেখেননি। বরং, সমরেশ যা লিখেছেন, সেটাই লেখা উচিত ছিল, নয়তো উপন্যাসটা ব্যর্থ হত।

যাই হোক বিয়ের গল্পে ফেরা যাক। একটি নাটক মঞ্চস্থ করার সুবাদে রাণুর সঙ্গে বুদ্ধদেবের পরিচয় হয়। ক্রমে অন্তরঙ্গতা বাড়ে। এবং বুদ্ধদেব বিয়ের প্রস্তাব দেন। সে সময় রানুর মামা নাকি বুদ্ধদেবকে মাতাল হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এর মদ-সিগারেটের খরচের ইয়ত্তা নেই। যদিও রানুর বাবা-মা সে-কথায় বিশেষ পাত্তা দেননি। মেয়ের ইচ্ছেকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেবের রোজগারে তারতম্য হয়েছে। দুঃখ-কষ্ট সংসারে যেমন থাকে, তেমনই ছিল। রানুর গান শেখাও ব্যাহত হয়েছে সে-কারণে। কিন্তু প্রতিভার এ নিয়ে কোনও অভিযোগ ছিল না। বরং নিবিড় প্রেম ও স্নেহে তিনি সংসারকে লালন করেছেন। বুদ্ধদেবের প্রেমকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, দারিদ্রের মালিন্য তা গ্রাস করেনি।

আর, কী করে বুদ্ধদেব হৃদয়ে ধরে রাখলেন এতখানি প্রেম? হ্যাঁ, তিনি তো মূলত কবি। তাই সংবেদনশীল মন তাঁর ছিলই। সে আলাদা কথা। প্রতি কবির সংসারই তবে সুখে-প্রেমে গুনগুনিয়ে উঠত, কিন্তু তা যে হয় না, আমরা জানি। আমার মনে হয়, এই যে গার্হস্থ্য প্রেম, তা তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। এই প্রেম হয়তো তাঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর মা, যাঁকে তিনি জীবনে দেখেনইনি। মোটে ১৬ বছর বয়সে বুদ্ধদেবের জন্ম দিতে গিয়েই তাঁর মৃত্যু হয়। বুদ্ধদেব মানুষ হন দাদু-দিদিমার কাছে। দিদিমাকেই মা বলতেন বুদ্ধদেব। নিজের মায়ের সম্পর্কে কোনও স্মৃতিই ছিল না তাঁর। কেবল একটা ছবি। এক যুবকের কাঁধে হেলান দিয়ে আছে এক তরুণী। তার চোখ দুটি বোজা, যুবকটি কোমর ধরে আগলে আছে তরুণীটিকে। মৃতা পত্নীকে নিয়ে এ-ছবি তুলেছিলেন বুদ্ধদেবের পিতা। ছবিটি যত্ন করে বহুদিন রেখে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেবের দিদিমা। পরে হারিয়ে যায়।

আত্মজীবনী লিখতে বসে বুদ্ধদেব যখন এ-ছবির কথা তোলেন, আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। বুদ্ধদেব লিখেছিলেন, তাঁকে জন্ম দিতে যাওয়ার পরিশ্রমেই যে মেয়েটির মৃত্যু হল, তাঁরও কিছু প্রাপ্য থেকে যায়। এই ছবি ও তার উল্লেখ থেকেই আমরা বুদ্ধদেবের পিতা-মাতার প্রেমঘেরা সংসারটিকে অনুভব করতে পারি। যা অমোঘ নিয়তিতে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে, অনেকখানি ভালোবাসা আর বেদনা না থাকলে কেউ এ ছবি তোলে না। আমার ধারণা, বুদ্ধদেবের সারা জীবনের এই যে প্রেম, এই যে ঘরোয়া বাঁধন, তার মূলে কোথাও নির্জ্ঞানে যেন থেকে যায় এই ছবিটি। বুদ্ধদেব নিজে বলছেন, সে ছবিকে তিনি কিছুমাত্র গুরুত্ব দেননি। কিন্তু মনে থেকে গিয়েছিল। নইলে আত্মজীবনীর পাতায় সে ছবির কথা উঠে আসত না। আর সেই স্থিরচিত্রটাকেই যেন সংসারে চলচ্ছবি করে তুলেছিলেন বুদ্ধদেব, সঙ্গী প্রতিভা।

এদিকে রবীন্দ্র-বিদ্বেষীর বদনাম যে কতবার জুটেছে তার ঠিক নেই। অথচ তাঁর মতো করে রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ঙ্গম করেছেন ক-জন! আমাদের সন্দেহ আছে। একজন যথার্থ আধুনিক সাহিত্যপ্রেমী হিসেবেই তিনি রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করতেন। ঠিক যেভাবে তরুণ রবীন্দ্রনাথ ক্ষুরধার সমালোচনা করেছিলেন মঙ্গলকাব্যের। এমনকি কমলে-কামিনীর চিত্রণে কবিকঙ্কণের কল্পনাশক্তির নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বুদ্ধদেব এই রবীন্দ্রনাথকেই তো আত্মস্থ করেছেন। ফলে, কোনও রকম গুরুবাদ তিনি বরদাস্ত করতে পারবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।

বুদ্ধদেব রামায়ণ বা মহাভারত মহাকাব্যকেও দেখতে চেয়েছিলেন দোষ-গুণ সমেত মানুষের মহারণ্য হিসেবে। এইখানে আর একজন নারীর কথা খুব মনে পড়ে। বুদ্ধদেবের দাদামশাইয়ের বিধবা মামীমা তাঁদের সঙ্গেই থাকতেন। প্রতিভা বিয়ের পর তাঁর স্নেহও পেয়েছেন। বুদ্ধদেব দেখেছেন, এই বিধবা রমণী কাশীবাস বা অন্যান্যভাবে জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। বরং প্রায় অন্যের সংসারে থেকেই তিনি ছিলেন জীবনের অনুরক্ত। এবং বিধবা জীবনের চেনা যে প্রকরণ তা যেন তিনি নিজের অজান্তেই ভেঙে একটা নতুন ব্যবস্থা বা নিয়ম গড়ে তুলেছিলেন, যা ভীষণভাবে নতুন। কিশোর বুদ্ধদেব হয়তো সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন, সংস্কার-ধর্ম-গুরুবাদ-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির অনেক ঊর্ধ্বে মানুষ এবং মানুষের জীবন। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টির মধ্যেও এসেছে।

উল্লেখ থাক, এই ঘটনাগুলোই বুদ্ধদেবের বৈদগ্ধ বা আধুনিকতার ভূমি নির্মাণ করেছে, এ-কথা বলছে না প্রতিবেদন। শুধু এই পণ্ডিত মানুষটিকে তাঁরই জীবনের ছোটো ঘটনার সূত্রে পুনরায় নির্মাণের চেষ্টা। আমরা বুদ্ধদেবকে দেখিনি। কিন্তু, তাঁর লেখা যে বুদ্ধদেবকে দেখিয়ে দেয় না, এ-কথা সত্যিই জোর দিয়ে বলা যায় না।

Powered by Froala Editor

More From Author See More