বিএসএনএল বলতে প্রথম কথাটি কী মনে পড়ে আমাদের? সম্পূর্ণভাবে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত এমন একটি সংস্থা; পুরোপুরি বেকার বা ফালতু, এমন একটি সংস্থা; লাখ লাখ ‘মাথামোটা’ অযোগ্য কর্মী কাজ করে চলেছে, এমন একটি সংস্থা অথবা মাঝেমধ্যেই সস্তায় কিছু প্ল্যান নিয়ে চলে আসা অথচ কোথাও নেটওয়ার্ক অথবা ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়া যায় না নাকি, এমন অভিযোগে জর্জরিত একটি সংস্থা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই পুরো ব্যাপারটিই, অর্থাৎ বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়ে বিলগ্নিকরণ থেকে শুরু করে আর্থিক লগ্নির মাধ্যমে নতুন রূপ দিয়ে ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক’ কর্মী নিয়ে উন্নত পরিষেবা প্রদান করার লক্ষ্যে মন দেওয়া উচিত বিএসএনএলের, এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটির পিছনেই একটি নির্দিষ্ট কর্পোরেট রাজনীতির ধাঁচ খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরও মাঝেমধ্যেই ‘অযোগ্য’ অথবা ‘অকর্মণ্য’ উক্তি শুনতে হলেও, যেভাবে বছরের পর বছর বিএসএনএলের মতো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের স্থায়ী-অস্থায়ী সমস্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের সময়মতো মাইনে দেওয়া হয়নি, যেভাবে সংবাদপত্রে কিংবা রাস্তাঘাটে অযোগ্য ও অকর্মণ্য প্রমাণ করে দেওয়া হয়েছে এক প্রকার, তা কিন্তু খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
বিংশ শতকের একদম শুরুতেই বিএসএনএল গঠনের সিদ্ধান্ত ছিল স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা ভারতের অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে একটি বড়সড় পরিবর্তন। সেই প্রথম প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর তৎকালীন এনডিএ সরকার টেলিকম মন্ত্রক থেকে বাইরে নিয়ে এসে তৈরি করে বিএসএনএল সংস্থা। উদ্দেশ্য ছিল সামনের দিনগুলিতে যে টেলিকম বিপ্লব হতে চলেছে তাতে বেসরকারি প্রতিযোগী সংস্থাগুলির সঙ্গে সমানে সমানে টেক্কা দেওয়া। তার জন্যই এই রকমের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি ছিল বলে জানানো হয়। তার আগে পর্যন্ত সেনাবাহিনী, রেল বা ডাক ব্যবস্থার মতো টেলিকম সেক্টরও ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল সম্পূর্ণভাবে। ইন্ডিয়া সরকারের এই সিদ্ধান্তের পরেই টেলিকম বিভাগ থেকে প্রায় ৩ লক্ষ কর্মী বিএসএনএলে যোগদান করতে চলে আসে।
কিন্তু অত্যন্ত প্রতিশ্রুতি জাগিয়ে শুরু করার কথা ছিল যে সংস্থাটির, তার এই করুণ পরিস্থিতির কারণটা ঠিক কী? ইতিহাসের পথ ধরে পিছনে হাঁটলে দেখা যাবে, মোবাইল পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রথমেই বেশ কয়েক ধাপ পিছনে পড়ে গিয়েছিল সরকারি সংস্থা। ১৯৯৫ সালেই বেসরকারি কোম্পানিগুলিকে মোবাইল পরিষেবা দেওয়ার ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হলেও বিএসএনএলের সেই লাইসেন্স পেতে সময় লেগে যায় আরো প্রায় সাত বছর। অর্থনীতির সাধারণ নিয়মেই, এক্ষেত্রে প্রথম যে সংস্থা একটি নির্দিষ্ট দ্রব্য বাজারে নিয়ে আসে, পরবর্তীকালে যে কোনও প্রতিযোগীর থেকে সহজে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হয় তার। এক্ষেত্রেও ঘটনাটি তাই। তাই কে বলতে পারে, রিলায়েন্সের বদলে কিংবা নিদেন পক্ষে একই সময়ে বিএসএনএলকেও যদি এই বিপ্লবে শামিল করা যেত, তাহলে শুধুমাত্র বেসরকারি সংস্থার হাতে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা জমা হত না এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাও মুখ থুবড়ে পড়ত না এই ভাবে।
কিন্তু হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সামলে নিয়ে নিয়েছিল বিএসএনএল। মোবাইল লাইন বা কানেকশনের টেন্ডার বাতিল করা থেকে শুরু করে পেশাদার সংস্থা হিসেবে বেড়ে উঠতে চাইলেও আধিকারিক বা কর্মচারী নিয়োগ করতে ন্যুনতম দক্ষতার পরিচয় না দেওয়া, ইত্যাদি টালবাহানা সত্ত্বেও সরকারি হিসেবেই ২০১৫-১৬ সালে বিএসএনএলের আর্থিক ক্ষতি কমতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে কার্যকরী মুনাফা করতে শুরু করার ঠিক পরেই আসল ধাক্কাটা আসে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উপর।
আরও পড়ুন
ম্যান্ডেরিন ভাষা শেখালে তবেই মিলবে শিক্ষকদের মাইনে, চিনের প্রস্তাবে বিতর্কে নেপাল
আশ্চর্যজনকভাবে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ফোর-জি স্পেকট্রামের নিলাম যখন শুরু হল, তখন এয়ারটেল, জিও বা আইডিয়া ফোর-জি লাইসেন্স পেয়ে গেলেও এই নিলামে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি সরকারি সংস্থা বিএসএনএলকেই! রিলায়েন্স জিওর ব্যবসা করার শুরুর দিনে সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় যে বিশাল বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল, তাতে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছবি নিশ্চয়ই চোখে পড়েছিল সকলেরই। অথচ আরেকটু উদ্যোগী হতে পারলে কে বলতে পারে, জিওর বদলে বিএসএনএলই হয়তো আক্ষরিক অর্থেই ঘরে ঘরে পৌঁছে যেত সমস্ত দেশবাসীর; সার্থক হত ‘কানেক্টিং ইন্ডিয়া’ শিরোনাম!
সরকারি তরফে কর্পোরেট বা সরকারি মিডিয়াকে ব্যবহার করে লাগাতার প্রচার করা হচ্ছে যে, বিএসএনএলের মোট আয়ের ৭৫ শতাংশ বেরিয়ে যাচ্ছে কর্মচারীদের বেতন দিতেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কখনোই সামনে আনা হচ্ছে না বিএসএনএলের রেভিনিউ কমে যাওয়ার ঘটনাটি। এছাড়াও বিএসএনএলকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর অনুমতিও দিচ্ছে না সরকার। টেলিকম কোম্পানিগুলির ঋণের পরিমাণ দেখলেই প্রমাণ হয়ে যায় এই কথা।
আরও পড়ুন
বেতন নেই প্রায় এক বছর, অফিসেই আত্মহত্যা বিএসএনএল কর্মীর
কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছিলেন বিএসএনএল থাকলেও বর্তমান আকারে বা পরিসরে থাকবে না। অর্থাৎ কর্মী ছাঁটাইয়ের একটা আভাস দিয়ে রাখাই হয়েছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল কর্পোরেট মিডিয়ার লাগাতার বিএসএনএল কর্মীদের অযোগ্য পদার্থ প্রমাণ করে তোলার পালা। এই পরিস্থিতিতে কাজ হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত কর্মীরা যে আরো নিরাশায় ডুবে যাবে তাতে আশ্চর্যের কী!
"বিএসএনএল সংস্থায় কাজ করছে ৮৫ হাজার দেশদ্রোহী, চাকরি থেকে তাড়ানো হবে সবাইকেই!" দিন কয়েক আগেই বিজেপি সাংসদ অনন্ত কুমার হেগড়ের এমন উক্তিতে চমকে গিয়েছিল সারা দেশ। দেশদ্রোহীতে ভরে যাওয়া বিএসএনএল সংস্থাকে বাঁচানোর জন্য তিনি নিদান দিয়েছিলেন এটা বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভবিষ্যতে বেসরকারি হাতে ঠেলে দেওয়া হবে। তার আগে সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার ভেসে এসেছে বিএসএনএল কর্মীদের কখনো কখনো দশ মাস কখনো বা তারও বেশি সময় বেতন না পাওয়ায় ঘটনা। আর্থিক যন্ত্রণায় আত্মহত্যার পথ খুঁজে নিয়েছেন কেউ কেউ। প্রায় এক বছর ধরে বেতন না পাওয়ায় তীব্র মানসিক চাপে সেই তালিকায় নতুন সংযোজন কলকাতারই ক্যালকাটা টেলিফোনসের ঠিকা কর্মী চঞ্চল দাশগুপ্ত। দেশজুড়ে বিএসএনএলের আরও বেশ কয়েক হাজার ঠিকা কর্মীর মতই তিনি এক বছরের বেশি সময় ধরে বেতন পাননি বলে দাবি পরিবার ও সহকর্মীদের।
এর কয়েকদিন আগেই লকডাউনের মধ্যে বিএসএনএলের আরেক ঠিকা কর্মী সুজয় ঘোষ দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিএসএনএলের ঠিকা কর্মীদের যে সংগঠন আছে তার তরফে জানানো হয়, নতুন যে টেন্ডার আনতে চলেছে সরকার তা ঠিকা কর্মীদের স্বার্থের চূড়ান্ত পরিপন্থী। এতে অবসরের বয়স এগিয়ে আনার সঙ্গেই বলা হয় মাসে কাজের দিন অর্ধেক হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ঘোরালো এবং সংকটজনক করে তোলা হচ্ছে বহুদিন থেকেই। কিন্তু লাগাতার বেসরকারি পুঁজির স্বার্থে কাজ করে যাওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের এই সব পদক্ষেপ আদতেই দেশবাসীর লাভের লাভ কিছু করতে করছে কিনা, সে নিয়ে ভাবার সময় এবার হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে, বেশি দেরি না হয়ে যায়!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor