পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল কিছুদিন ধরেই। তবে অকস্মাৎ দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। চোখের সামনে আগুনের গ্রাসে চলে গেল অসংখ্য ঘরবাড়ি, হোটেল। আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগের সেই দিনের স্মৃতি এখনও আমেরিকার বহু মানুষের মনের মধ্যে জীবন্ত। কেউ কেউ হয়তো নতুন প্রজন্মকে শোনাচ্ছেন সেই ইতিহাস। তাঁদের পারিবারিক ইতিহাস। ছোট্ট শিশুরা হয়তো অবাক হয়ে ভাবছে, কী অর্থ এই গল্পের! হয়তো গল্পের মধ্যে একটিমাত্র শব্দ আকর্ষণ করেছে কাউকে। ‘ব্ল্যাক ওয়ালস্ট্রিট’। হ্যাঁ, অবাক করার মতোই শব্দ। ওয়ালস্ট্রিট মানে মার্কিন অর্থনীতির কেন্দ্র। কিন্তু ব্ল্যাক ওয়ালস্ট্রিট? হ্যাঁ, ১০০ বছর আগের জাতিদাঙ্গায় যে এলাকা পুড়েছাই হয়ে গিয়েছিল, তাকে ব্ল্যাক ওয়ালস্ট্রিট নামেই চিনতেন সকলে।
ইতিহাসের সূত্র ধরে পিছিয়ে যেতে হয় আরও কিছুটা। তখন উনিশ শতকের মাঝামাঝি। আমেরিকাজুড়ে তখনও প্রবল হয়ে আছে দাসপ্রথা। লেখাপড়া তো দূরের কথা, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আসা বন্দি মানুষদের নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকারও ছিল না। তার মধ্যেই একটু একটু করে মুক্তির স্বপ্ন বুনছেন অনেকে। একে একে বেশ কিছু প্রদেশে অবশ্য দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হচ্ছে। নিউইয়র্ক শহরে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন অনেক বন্দি দাস। ঠিক এরকম সময়ে ১৮৭০-এর দশকে ওকলাহোমা প্রদেশে নিষিদ্ধ হল দাস ব্যবস্থা। আর এই ওকলাহোমা প্রদেশের তুলসা শহরের বুকে গড়ে উঠল প্রায় এক মুক্তাঞ্চল। ১৯২০ সালের মধ্যে আমেরিকার অন্যতম বিত্তশালী এলাকাগুলির একটি হয়ে উঠল তুলসা শহর। ৫০টির বেশি হোটেল, অসংখ্য রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, পোলো পুল – এমনই নানা আয়োজন। আর এই সমস্তকিছুর মালিকানা তথাকথিত ‘নিগ্রো’-দের হাতে। মাত্র ৫০ বছর হল যাঁরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছেন। একদিন যাঁদের পায়ের তলায় রাখতেই অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁদের এই ঐশ্বর্য সহ্য হল না সাদা চামড়ার মানুষদের।
১৯২১ সালের মে মাসের শুরুতেই রটে গেল তুলসা শহরের এক ‘নিগ্রো’ কিশোরের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন এক অভিজাত কিশোরী। সেই কিশোরীর পরিচয় বা কবে কখন এই ঘটনা ঘটেছে, তা অবশ্য জানা যায়নি। দাঙ্গার জন্য অবশ্য এতকিছু জানার প্রয়োজনও হয় না। পরিকল্পনা-প্রস্তুতি চলছিলই। ৩১ মে হঠাৎ একদল সাদা চামড়ার সশস্ত্র মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্ল্যাক ওয়ালস্ট্রিটের বুকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা, প্রশাসন যেন আরও বেশি করে দাঙ্গায় ইন্ধন জোগাল। ১ জুন লাগু হল মার্শাল আইন। দুদিনের দাঙ্গার শেষে অন্তত ১০ হাজার মানুষ ওকলাহোমা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছেন। খাতায় কলমে মৃতের সংখ্যা ৩৬। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে তা ৩০০-র কম নয়। মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে কালো চামড়ার মানুষদের যে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড গড়ে উঠেছিল, তা ভেঙে গেল এক লহমায়।
এরপর অনেক বছর কেটে যায়। ৫০-৬০ এর দশকে জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে আমেরিকা। তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক নানা আইনও তৈরি হয়েছে। কিন্তু ১৯২১ সালে মার্শাল আইনে অভিযুক্ত মানুষরা তখনও পুলিশের তালিকায় অপরাধী হিসাবেই থেকে যান। অবশেষে ১৯৯৯ সালে ওকলাহোমা প্রদেশে গঠিত হয় বিশেষ কমিটি। ২০০১ সালে বিশদ রিপোর্ট প্রকাশ করে সেই কমিটি। ১৯২১ সালের ঘটনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায় ওকলাহোমা প্রশাসন। এমনকি সেই সময়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের উত্তরসূরিদের জন্য বিশেষ আর্থিক সুযোগসুবিধার প্যাকেজও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেই মর্মান্তিক দাঙ্গার ক্ষত কি এত সামান্য আয়োজনে ভুলে যাওয়া যায়? আজও তা ভুলতে পারেননি তাঁরা। লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় খুব সামান্যই। কিন্তু অসংখ্য গল্পকথায় আজও তীব্র হয়ে আছে তুলসা দাঙ্গার ক্ষত।
আরও পড়ুন
‘ডাস্টবিন স্কুল’-এ পাঠানো হত কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের, প্রকাশ্যে ইংল্যান্ডের অমানবিক ছবি
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
২৪ ঘণ্টায় পুলিশের গুলিতে নিহত ৬ কৃষ্ণাঙ্গ, ফ্লয়েডের স্মৃতি ফিরছে আমেরিকায়