‘বি ওয়াটার মাই ফ্রেন্ড…’
একটা সময় গোটা বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল এই কিংবদন্তি ডায়লগ। চলচ্চিত্র এবং মার্শাল আর্টের জগতের অন্যতম তারকা ব্রুস লি-র মুখে শোনা গিয়েছিল এ-কথা। ক্যারাটের সাধনা করতে গেলে নিজের শরীরকে নমনীয় করতে হয়, বলতে চেয়েছিলেন ব্রুস (Bruce Lee)। তবে সাড়া জাগানো এই বক্তব্যই শেষ অবধি ‘আইরনিক্যাল’ হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছেই।
হ্যাঁ, সম্প্রতি প্রকাশ্যে এল এমনই এক আশ্চর্য তথ্য। অতিরিক্ত জল পান করার ফলেই নাকি মৃত্যু (Death) হয়েছিল ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ ছবির মুখ্য অভিনেতার।
১৯৭৩ সাল। ১০ মে। হংকং-এর গোল্ডেন হার্ভেস্ট ফিল্ম স্টুডিও-তে সেদিন ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’-এর শ্যুটিং চলার সময়ই হঠাৎ মেঝেতে পড়ে যান তিনি। মাথার যন্ত্রণা এবং খিঁচুনি— এই দুই উপসর্গই দেখা দিয়েছিল তাঁর শরীরে। তৎক্ষণাৎ তাঁকে ভর্তি করা হয় হংকং-এর স্থানীয় একটি হাসপাতালে। তবে লাভ হয়নি কোনো। ‘সেবিব্রাল এডেমা’ নামের এক আশ্চর্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে রহস্যজনকভাবেই প্রয়াত হন ব্রুস লি। চক্রান্ত করে তাঁকে খুন করা হয়েছে, এমন কনস্পিরেসি থিওরি মঁ মঁ করত সে-সময়কার আকাশে-বাতাসে। নাম উঠে এসেছিল তাঁর স্ত্রী লিন্ডা কিংবা সহকারী অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা জর্জ লেজেনবাই-এর। তবে শেষ পর্যন্ত প্রমাণ মেলেনি কিছুরই। দেহে কোনো বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন তো বটেই, শরীরে কোনো বিষের উপস্থিতিও নজরে আসেনি পোস্ট মর্টেমের সময়। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আসার পর হঠাৎ করে কেন তাঁর এই মৃত্যুর জন দোষারোপ করা হচ্ছে পানীয় জলকে?
মানুষের কিডনির জলধারণ ক্ষমতা আদতে ঠিক কতটা, কতটা বাড়তি জল মানুষের শরীর গ্রহণ করতে পারে— বছর কয়েক আগে এই বিষয় নিয়েই গবেষণা শুরু করেছিলেন স্পেনের একদল গবেষক। তাঁদের গবেষণাতেই উঠে আসে এক বিশেষ শারীরিক অবস্থার কথা। যার নাম হাইপোনাট্রেমিয়া। এই অবস্থার দরুন হঠাৎ করে হ্রাস পায় সোডিয়ামের মাত্রা। প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে এই পরিস্থিতি।
আসলে প্রচুর পরিমাণে জল দেহে ক্রমাগত প্রবেশ করাতে থাকলেও, রক্ত পরিশ্রুত করার গতি বৃদ্ধি করতে পারে না মানুষের কিডনি। ফলে, মানুষের রক্তে ক্রমশ বাড়তে থাকে জলের পরিমাণ। অন্যদিকে জলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় কমে যায় সোডিয়ামের ঘনত্ব। কাজেই উপযুক্ত মাত্রায় সোডিয়ামের অভাব দেখা দেয় মানবদেহে। দীর্ঘ সময় ধরে এমন পরিস্থিতির শিকার হলে, মানুষের প্রতিটি অঙ্গও ধীরে ধীরে জল শোষণ করা শুরু করে। শুরু হয় অভ্যন্তরীণ প্রদাহ।
ব্রুস লি-র ক্ষেত্রেও ঘটেছিল এমনটাই, দাবি গবেষকদের। আসলে এই গবেষনার পাশাপাশি ব্রুস লির পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেরও তুলনা ও বিশ্লেষণ করেছেন তাঁরা। আর সেখানেই ধরা পড়ে বেশ কিছু অস্বাভাবিক পরিসংখ্যান। যার প্রথমটিই হল মস্তিষ্কের ওজন। একজন সুস্থ পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের ওজন হয় ১৪০০ গ্রাম। অথচ, মৃত্যুর সময় ব্রুস লির মস্তিষ্কের ওজন ছিল ১৫৭৫ গ্রাম। গবেষকরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, অতিরিক্ত জল শোষণ করেই ভারী হয়ে গিয়েছিল তাঁর মস্তিষ্ক। পাশাপাশি মস্তিষ্কের মধ্যে রক্তও জমাট বাঁধে তাঁর। এক্ষেত্রে গবেষকরা টেনে এসেছেন সোডিয়ামের প্রসঙ্গ। সোডিয়ামের অভাবেই ক্রমশ জমাট বাঁধতে শুরু করে রক্ত। দাবি তাঁদের। এসব তত্ত্বের বাইরেও যে প্রশ্নটা থেকে যায়, তা হল হঠাৎ করে প্রয়োজনের বেশি পানীয় জল পান করেছিলেন কেন ব্রুস লি?
এই প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া যায় তাঁর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকেই। মার্শাল আর্টিস্ট হওয়ার কারণে, স্বাভাবিকভাবেই শরীরকে হাইড্রেটের রাখার প্রয়োজন হত ব্রুসের। তাই পানীয় জল ছাড়াও, বিভিন্ন এনার্জি ড্রিংক, প্রোটিন ড্রিংক-সহ তাঁর ডায়েটে তরল পুষ্টির তালিকাটা ছিল বেশ দীর্ঘ। পাশাপাশি মৃত্যুর দিন গঞ্জিকা বা মারিজুয়ানা সেবন করেন ব্রুস লি। যা উল্লেখিত হয়েছিল ১৯৭৩-এর রিপোর্টেই। মারিজুয়ানাকে প্রাণঘাতী বলে চিহ্নিত করেননি তৎকালীন চিকিৎসকরা। তবে এই মারিজুয়ানাই তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রুস লির। অর্থাৎ, শরীরের বাড়তি জলের প্রয়োজন না থাকলেও, কেবলমাত্র তেষ্টা মেটাতেই ক্রমাগত জল পান করে গিয়েছিলেন তিনি। যা পরবর্তীতে তাঁকে ঠেলে দেয় হাইপোনাট্রেমিয়ার দিকে।
সম্প্রতি ক্লিনিক্যাল কিডনি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে স্প্যানিশ গবেষকদের এই গবেষণাপত্রটি। যা রীতিমতো নতুন করে আন্দোলন তুলেছে বিশ্বজুড়ে! অতিরিক্ত জলপান নিয়ে সতর্ক হওয়ার বার্তা দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এতদিন পর্যন্ত জল ‘জীবন’ বলেই পরিচিত ছিল মানবসভ্যতায়। এবার তাঁর নতুন ‘ঘাতক’ চরিত্র অবাক করল সকলকেই…
Powered by Froala Editor