শরণার্থী জীবন ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে তুলে ধরেই নোবেলজয় তাঞ্জানিয়ান কথাসাহিত্যিকের

দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার পর জানা গিয়েছে যুবকটির প্রেমিকা সন্তানসম্ভবা। প্রেমিকার বাড়িতে তাঁর বাবা-মাকে এই ‘সুখবর’ জানাতে যান যুবকটি। কিন্তু কোনো সুখবরের প্রতিক্রিয়ায় এমন ঘৃণা মিশে থাকতে পারে? যুবকটির কথাতেই সেই ঘৃণার বর্ণনা ফুটে ওঠে। তারপর কাহিনির সূত্র ধরে পিছিয়ে যায় ২০ বছর আগের মুহূর্তে। তাঞ্জানিয়ার একটি ছোট্ট শহর থেকে ইংল্যান্ডে চলে এসেছিল যুবকটি। তারপর অসংখ্য ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে বিদেশের মাটিতে জায়গা করে নেওয়ার লড়াই। এই গল্প তো আসলে লেখকেরই নিজের কথা। অথবা পুরোপুরি নিজের কথা নয়। তাঁর মতোই আফ্রিকা থেকে চলে আসা অসংখ্য মানুষের জীবনকে এক সুতোয় গেঁথে তুলেছেন আবুদলরাজাক গুরনাহ (Abdulrazak Gurnah)। চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (Nobel Prize) পেলেন ইংল্যান্ড প্রবাসী এই ঔপন্যাসিক।

১৯৪৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবার দ্বীপে জন্ম আবদুলরাজাকের। তাঞ্জানিয়া তখনও ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। ঔপনিবেশিকতার চরম রূপ ছোটো থেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। এরপর ১৯৬৮ সালে আবদুলরাজাক ইংল্যান্ডে চলে আসেন পড়াশোনার জন্য। শুরু হল একটা নতুন জীবন। কিন্তু তাঁর আফ্রিকান পরিচিতি যেন কিছুতেই পিছি ছাড়ল না। কিছু প্রগতিশীল মানুষের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেলেও অনেকেই তাঁকে দেখতেন সন্দেহের চোখে। আর আফ্রিকান মানেই অসংখ্য ইংরেজের কাছে তিনি ছিলেন ক্রীতদাসের সমান। এই সমস্ত সময়ের কথাই পরে উঠে এসেছে তাঁর কলমে। ছাত্রাবস্থা থেকেই লেখালিখির অভ্যাস ছিল তাঁর। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণার শেষে ১৯৮০ সালে নাইজিরিয়ার বায়রো ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালে সেখান থেকে চলে যান কেন্ট ইউনিভার্সিটিতে। এই সময় থেকেই পুরোদস্তুর সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তিনি।

১৯৮৭ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘মেমোরি অফ ডিপার্চার’। সেই তাঞ্জানিয়া থেকে ইংল্যান্ডে পালিয়ে আসা এক যুবকের গল্প। কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে সেই যুবক পালিয়ে আসতে বাধ্য হল, তাই কাহিনির মূল বিষয়। আর এভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন ঔপনিবেশিক সময়ের আফ্রিকার ছবি। ক্রমশ একে একে প্রকাশ পায় ‘পিলগ্রিমস অফ ওয়ে’, ‘ডোটি’। ১৯৯৪ সালে ‘প্যারাডাইস’ উপন্যাসটি মনোনীত হয়েছিল বুকার পুরস্কারের জন্য। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স’। শুরুতেই সেই উপন্যাসের কাহিনির কথা বলা হয়েছে। নিজের লেখায় যেমন ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ের ছবি তুলে ধরেছেন, তেমনই দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বহু সাহিত্যিকের লেখাকে ব্রিটেনের পাঠকদের কাছী হাজিরও করেছেন তিনি। আবদুলরাজাকের উদ্যোগেই প্রকাশিত হয় পোস্টকলোনিয়াল লেখকদের একটি প্রবন্ধ সংকলন। তাতে ভিএস নাইপল, সলমন রুশদি, জো উইকম্বের মতো লেখকের লেখা স্থান পায়। এছাড়াও সলমন রুশদির সাহিত্যের উপরে একাধিক সমালোচনামূলক লেখা লিখেছেন তিনি।

বর্তমান সময়ে যখন সারা পৃথিবীতে উদ্বাস্তু সমস্যা এক বহুল আলোচিত বিষয়, তখন যেন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এই লেখাগুলি। তাই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েই তাঁকে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নিল রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি। আবদুলরাজাক গুরনাহ-র নোবেলপ্রাপ্তি যেন সমস্ত শরণার্থী মানুষদের জীবনকেই সম্মান জানানোর মুহূর্ত।

Powered by Froala Editor

Latest News See More