আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগের কথা। প্রিয়তমা স্ত্রী মুমতাজ বেগমের স্মৃতিতে যমুনার তীরে প্রকাণ্ড এক সমাধিসৌধ নির্মাণ করেছিলেন মোঘল সম্রাট শাহজাহান। চার শতক পর, আজও গোটা বিশ্বের কাছেই বিস্ময় তাজমহল (Taj Mahal)। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে শাহজাহানের তৈরি এই স্থাপত্য। কিন্তু আজ যে তাজ মহলের ছবি দেখে অভ্যস্ত আমরা, নির্মাণকালে তার রূপ ছিল খানিক ভিন্ন। ২৮ ধরনের বিরল পাথর, সোনা, রুপো ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর কারুকার্য ছিল তাজমহলে। ক্ষমতায় আসার পর সেইসব মহামূল্য সামগ্রী ‘চুরি’ করেছিল ব্রিটিশ সরকার (British Raj)।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, তাজ মহলে একসময় ‘লুঠ’ চালালেও, ব্রিটিশদের নেপথ্যেই ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল শাহজাহানের এই অমোঘ সৃষ্টি। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি। তাজমহলের সৌন্দর্য, তার কিংবদন্তি শোষকদেরও করে তুলেছিল মানবিক।
আট দশক পিছিয়ে গিয়ে শুরু করা যাক এই গল্প। সেটা চল্লিশের দশকের একদম শুরুর দিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War) দামামা বেজে গেছে ততদিনে। ইউরোপ তো বটেই, গোটা বিশ্বই দ্বিবিভক্ত অক্ষ ও মিত্রপক্ষে। সেই যুদ্ধে নাৎসি জার্মানির প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ব্রিটেন। অন্যদিকে ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ায় অনিবার্যভাবেই জড়িয়ে পড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। ফলে দৈনন্দিন জার্মান এবং জাপানি বোমারু বিমানের আনাগোনা লেগেই থাকত ভারতের আকাশে। অক্ষ শক্তির বোমারু বিমানের আক্রমণের শিকার হয় কলকাতা-সহ একাধিক অঞ্চল। স্বাভাবিকভাবে হিটলারের হিটলিস্ট থেকে বাদ ছিল না দিল্লির নামও। ফলে, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল তাজমহলের ভাগ্যও।
তাজমহল আজ যেমন গোটা পৃথিবীর কাছে বিস্ময়, তৎকালীন সময়েও তার খ্যাতি বিশ্বে কম ছিল না এতটুকু। পাশাপাশি ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশের বৃহত্তর মানচিত্রের অংশ হওয়ায়, তাজমহলের মতো সৌধ ঈষৎ গর্বের কারণও ছিল ইংরেজদের কাছে। কাজেই এমন এক ঐতিহাসিক নিদর্শনকে অক্ষশক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে তড়িঘড়ি বন্দোবস্ত নেয় ব্রিটিশরা। রাতারাতি স্থপতিদের নিয়ে বৈঠকে বসে উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ আধিকারিকরা। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, কোনো আচ্ছাদনে ঢেকে ফেলা হবে তাজমহলকে।
আরও পড়ুন
বাদ তাজমহল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সেলুলার জেল; কোন ইতিহাস চেনাচ্ছে ইউজিসি?
কিন্তু কীভাবে ঢেকে ফেলা হবে তাজ মহলের মতো বিশালায়তনের সৌধকে? উপায় বাতলান এক ব্রিটিশ স্থপতি। তাজমহলকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয় আয়তকার বাঁশের খাঁচা। মূল সৌধ এবং চার দিকের চারটি মিনারকে পৃথক পৃথকভাবে পুরে ফেলা হয় বাঁশের আচ্ছাদনে। পাশাপাশি খালি করে দেওয়া হয় আশপাশের লোকালয়। ব্রিটিশ স্থপতিদের এই পরিকল্পনাই সাফল্য এনে দেয় বিশ্বযুদ্ধে।
আরও পড়ুন
তাজমহলের নিচে সত্যিই কি রয়েছে কোনো সুড়ঙ্গ? রহস্য দীর্ঘদিনের
তখনও পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়নি বহুলভাবে। বাজারে আসেনি অত্যাধুনিক র্যা ডার কিংবা অবজেক্ট ডিটেক্টিং টেকনোলজি। দূরবিন এবং কম্পাসই একমাত্র ‘হাতিয়ার’ বিমানীদের কাছে। আকাশ থেকে সেসময় তাজ মহলকে দেখলে বাঁশের স্তূপ বলেই মনে হত যে-কোনো বিমানচালকের। পাশাপাশি আশেপাশে লোকালয় না থাকায়, ওই অঞ্চলে বোমাবর্ষণও অপ্রয়োজনীয় বলেই মনে করেছিল অক্ষশক্তি। ফলে, গোটা বিশ্বযুদ্ধে বিন্দুমাত্র আঁচড় পড়েনি তাজমহলে।
আরও পড়ুন
তাজমহলের দেওয়ালে ক্যালিগ্রাফি তাঁরই; পাঞ্জাবের গ্রামে ধুঁকছে বিস্মৃতপ্রায় শিল্পীর শেষ চিহ্ন
এই একই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল ১৯৬৫ এবং ’৭১-এর ভারত পাক যুদ্ধের সময়েও। সে-সময়ও সাফল্য মিলেছিল একশো শতাংশ। তবে বিশ্বযুদ্ধই প্রথম নয়। ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্রিটিশ শাসকরা একাধিকবার তাজমহলের ক্ষতিসাধন করলেও, ১৯০৮ সালে প্রথম তাজমহল সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বড়লাট লর্ড কার্জন। ব্রিটিশ শাসকরা সেদিন মানবিক না হলে হয়তো আজ অস্তিত্ব থাকত না শাহজাহানের শখের এই স্মৃতিসৌধের।
Powered by Froala Editor