সাল ১৯৪১, জুন মাস। তখনও শ্রাবণ আসেনি। একটু একটু করে প্রকৃতির ভেতর জেগে উঠছে বর্ষা। শান্তিনিকেতনে রোগশয্যায় শুয়ে আছেন একজন মানুষ। তাঁর শ্রান্ত, ঋষিপ্রতিম মুখে কীসের যেন ছায়া পড়েছে। অসুস্থতা তাঁকে কাবু করতে পারেনি কখনও। এখনও মুখে একরাশ আলো, কিন্তু অন্ধকারও নেমে এসেছে বারান্দায়। মৃত্যুঞ্জয় হলেও তাঁর আকুতি, ‘মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’।
রবীন্দ্রনাথের শেষবেলার সেই শান্ত চেহারা অনেকেই ধরেছেন। গাছের পাতাগুলোর অবিরাম ঝড়ে পড়া লক্ষ করেছিলেন অনেকে। সেই সময়ের একটি ঘটনার দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। সাল সেই একই, ১৯৪১। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়। বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় সময়। নাগিনীরা চারিদিকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করে দিয়েছে। এদিকে দেশের স্বাধীনতার দাবিও তীব্র হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় বিপ্লব, বিদ্রোহ। ইংরেজ সরকার যত কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, ততই নিজের কামড় মজবুত করছে। সব মিলিয়ে এক ঐতিহাসিক দোলাচলের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল তখনকার ভারতবর্ষ।
ইতিমধ্যে ভারতের এই অবস্থা নিয়ে ব্রিটেনে চলছে নানা আলোচনা। বিশ্বের নানা জায়গায় এই দেশটির স্বাধীনতার সংগ্রামের খবর পৌঁছে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ইংরেজ রাজনীতিবিদরা শুরু করলেন মিথ্যা প্রচার। সেই দলেই ছিলেন মিস রাথবোন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের জনপ্রিয় এই সাংসদ সেখানকার শিক্ষিত সমাজেও বিশেষ পরিচিত। তাঁর মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন সবাই। সেই মিস রাথবোনই ভারতের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেন। একটি খোলা চিঠিতে দেশের নিন্দা করে একের পর এক অভিযোগ তোলেন। তাঁর বক্তব্য, এই ভারতই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে ব্রিটিশদের জন্য। আর আজ তাঁদেরই মারছে! বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যোগ দিতে অস্বীকার করছে! এ কেমন প্রতিদান…
মিস রাথবোনের এই খোলা চিঠি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিক্রিয়া হল সাংঘাতিক। সেই ঝড় এসে লাগল শান্তিনিকেতনের গায়েও। ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কানেও গেছে সেই খবর। তখন গুরুতর অসুস্থ তিনি, রোগশয্যায়। কবিরাজি মতে চিকিৎসা শুরু হয়েছে তাঁর। মিস রাথবোনের এই মন্তব্য শুনে আর স্থির থাকতে পারলেন না তিনি। ঠিক করলেন, এর জবাব দিতেই হবে। আর তিনি দেবেনও।
এটা এমন একটা সময়, যখন রবীন্দ্রনাথ আর নিজের হাতে কিছু লিখতে পারেন না। তিনি বলেন, সেটা শুনে কেউ একজন লিখে নেন। ঠিক করলেন এভাবেই নিজের বক্তব্য জানালেন। কৃষ্ণ কৃপালিনী দায়িত্ব নিলেন রবীন্দ্রনাথের কথা লিপিবদ্ধ করার। খোলা চিঠির বিপরীতে খোলা চিঠিই হবে এর উত্তর। ১৯৪১-এর ৫ জুন, ভারতের সমস্ত ইংরেজি সংবাদপত্রে ছাপা হল সেই চিঠি— রবি ঠাকুরের প্রতিবাদপত্র।
ঠিক কী বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? “ভারতীয়দিগকে লিখিত মিস রাথবোনের খোলা চিঠি পড়িয়া আমি গভীর বেদনা অনুভব করিয়াছি। …তাঁহার এই পত্র প্রধানত জওহরলালের উদ্দেশ্যেই লিখিত এবং একথা আমি নিঃসন্দেহে বলিতে পারি, মিস রাথবোনের দেশবাসীগণ আজ যদি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহানুভব যোদ্ধার কণ্ঠ কারাপ্রাচীরের অন্তরালে রুদ্ধ না রাখিত, তাহা হইলে তিনি মিসের এই অযাচিত উপদেশের যথাযোগ্য ও সতেজ উত্তর দিতেন। বলপ্রয়োগজনিত তাঁহার মৌন আমাকেই, রোগশয্যা হইতেও, এই প্রতিবাদ জানাইতে বাধ্য করিয়াছে।…” প্রসঙ্গত, তখন কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতাই কারাগারের ওপারে ছিলেন। গান্ধীজি, নেহরু-সহ প্রথম সারির নেতারাও সেই দলে ছিলেন।
মিস রাথবোনের কথা যে একেবারেই ভ্রান্ত, সেই কথাই বারবার উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর মতে, ব্রিটিশ চিন্তাধারার খুব কম অংশই আমরা গ্রহণ করেছি। যেটুকু পাশ্চাত্যের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের গৌরবজনক দিক, কেবল সেইটুকুই। এবং সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সরাসরি মন্তব্য, “… আমাদের যে-সকল ইংরেজ বন্ধু মনে করেন যে, তাঁহারা যদি আমাদের ‘শিক্ষাদান’ না করিতেন তাহলে আমরা অজ্ঞানান্ধকারের যুগেই থাকিয়া যাইতাম, তাহাদের এই মনোভাব দাম্ভিক আত্মতৃপ্তি ছাড়া আর কিছুই নহে।” তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ তত্ত্ব দিয়ে তিনি পুরো খারিজ করে দেন রাথবোনের বক্তব্য। ইংরেজদের অত্যাচারের একের পর এক নমুনা তুলে ধরলেন তিনি। দেখিয়ে দিলেন ‘সভ্য’ ইংরেজদের আচরণ। এটা তো একা এক ইংরেজ রমণীর বক্তব্য নয়, একজন পার্লামেন্ট সাংসদের বক্তব্য। গোটা দেশকে অপমান করার তো কোনো মানে হয় না। যতই রোগ থাকুক, এর প্রতিবাদ তো করবেনই রবি ঠাকুর। জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনা ভুলে গেলে চলবে!
এই চিঠি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার পরে কী হয়, জানা যায় না। রাথবোনের কাছে নিশ্চয়ই পৌঁছেছিল এই সংবাদ। ততদিনে রবীন্দ্রনাথের শরীর আরও ভেঙে পড়ে। কবিরাজি ওষুধ কিছুই করতে পারছে না। বিধান রায়-সহ অন্যান্য ডাক্তাররা চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন। শেষ পর্যন্ত চলে এল ২৫ জুলাই, বাংলায় ৯ শ্রাবণ। বরাবরের মতো প্রাণের শান্তিনিকেতন ছাড়লেন রবীন্দ্রনাথ। আর তারপরই, ৭ আগস্ট… ২২ শ্রাবণ…
তথ্যসূত্র— ‘রবিজীবনী’/ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor