তৃষ্ণার্ত সেনানীরা, বিশ্বযুদ্ধে বিয়ার ফেরির দায়িত্বে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান!

তলায় ইংলিশ চ্যানেল। আর আকাশপথে ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দুটি যুদ্ধবিমান। যুদ্ধজাহাজ থেকে গোটা ব্যাপারটার নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছিলেন ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির সেনারা। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরেই চলছে যুদ্ধ। আকাশপথে এহেন সংঘর্ষ নতুন কিছুই নয়। কিন্তু আজকের লড়াই যেন এক তরফা। যেন কোনো প্রতি-আক্রমণ না করে, পালিয়ে বাঁচতে চাইছে একপক্ষ। সেটাই বেশ আশ্চর্যের। তবে অবাক হওয়ার অবকাশ ছিল বৈকি। বিপক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে বাড়তি ফুয়েল ট্যাঙ্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলল একটি বিমান। আর তা শূন্য থেকেই খসে পড়ল ইংলিশ চ্যানেলে। এবার অগ্নিকাণ্ড বাঁধবে, তেমনটাই আশঙ্কা করেছিলেন নৌসেনারা। কিন্তু কোথায় অগ্নিকাণ্ড? বরং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যেন চনমনে হয়ে উঠল সমুদ্রের নোনা বাতাসও। চারিদিক ম-ম করছে অ্যালকোহলের গন্ধে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বিয়ারের গন্ধে। কিন্তু এই যুদ্ধক্ষেত্রে বিয়ার?

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিয়ারই। এই অদ্ভুত ঘটনার প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। গল্পের খাতিরেই আরেকটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। এটা যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন ধীরে ধীরে পিছু হটছে নাজি বাহিনী। ১৯৪৪ সাল। ফ্রান্সে তখন যুদ্ধরত রয়্যাল আর্মি। সাফল্যও মিলছে বেশ। হিটলারের করায়ত্ত ফ্রান্সের অঞ্চলগুলিকে একে একে মুক্ত করছে ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনী। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্য জায়গায়। কী রকম?

আসলে শুধুমাত্র বোমা, গুলি, যুদ্ধবিমান আর ট্যাঙ্ক দিয়েই তো একটা যুদ্ধ চলতে পারে না। সেনানীদের বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকা দরকার। ভিনদেশে যুদ্ধ করতে এসে ঠিক এই জায়গাটাতেই ফ্যাসাদে পড়লেন ব্রিটিশ সেনারা। ফ্রান্সের ঘাড়ে তখন নিঃশ্বাস ফেলছে আর্থিক মন্দা। ফলে, বিলাসিতাকে সরিয়ে রেখে যুদ্ধেই সবটা উজাড় করে দিচ্ছে ফরাসি সরকার। বন্ধ করা হয়েছে অ্যালকোহলজাত পানীয়ের উৎপাদনও। এদিকে সোডা ওয়াটার খেতে খেতে ওষ্ঠাগত ব্রিটিশ সেনাদের প্রাণ। এভাবে তো দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায় না! দরকার স্থায়ী সমাধানের।

ঠিক হল ছোট্ট যুদ্ধবিমানে করে সরাসরি ব্রিটেন থেকে নিয়ে আসা হবে বিয়ার। কিন্তু কীভাবে? তাতে তো কার্গো রাখার জায়গা নেই আলাদা করে! এই সমস্যার অভিনব এক সমাধান খুঁজে বার করলেন আরএএফের বিমানচালকরাই। পরিকল্পনা করা হল, যুদ্ধবিমানের পাখনার নিচে যে বাড়তি জ্বালানি বহনকারী দুটি ট্যাঙ্ক রয়েছে— তাতেই বিয়ার ভরে নিয়ে যাওয়া হবে ফ্রান্সে। 

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের ৭৬ বছর পরেও নাৎসি শাসন! জার্মানিতে আজও রয়েছে এই গ্রাম

যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। স্পিটফায়ার বিমানের দুটি ড্রপ ট্যাঙ্কে চেপে ৯০ গ্যালন বিয়ার পাড়ি দিল ফ্রান্সে। সফলও হল প্রয়াস। বিমান থেকে ট্যাঙ্ক নামানোর পরেই এক তৃপ্তির হাসি খেলে গেল সেনানীদের মধ্যে। কয়েক হাজার মিটার উচ্চতায় উড়িয়ে আনার কারণে, এ বিয়ার যে একেবারে ঠান্ডা কনকনে। কিন্তু সে বিয়ার মুখে দিতেই মাঠে মারা গেল উচ্ছ্বাস। তাতে যে মিশে রয়েছে গ্যাসোলিন আর ধাতব ট্যাঙ্কের গন্ধ। বাষ্প দিয়ে ভালো করে ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের পরেও সেই গন্ধ যায়নি একেবারেই! তা বলে তো বিয়ার ফেরি বন্ধ করে দেওয়া যায় না। এবার ধাতব ট্যাঙ্কের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল আস্ত কাঠের ব্যারেল। তাতে বিয়ারের পরিমাণ কমল খানিকটা। তবে স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকল তার। 

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরমে, ‘শত্রুপক্ষ’ আমেরিকার বুকে মার্চ করলেন হিটলার!

কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল ততই যেন বাড়ছিল বিয়ারের চাহিদা। শেষে যোগান সামাল দিতে স্পিটফায়ারের বদলে টাইফুন যুদ্ধবিমানে বিয়ার পরিবহন শুরু করে ব্রিটেনের বাহিনী। আর তাতেই বিপত্তি। জার্মান ‘ফোক-ওলফ ১৯০’ যুদ্ধবিমানের সঙ্গে টাইফুনের সাদৃশ্য থাকায় মাঝে মাঝেই ভুলবশত সেগুলি আক্রমণ করে বসত অনভিজ্ঞ মার্কিন বিমানচালকেরা। এমনকি একই দিনে একটি বিয়ারবাহী বিমানকে দু’বার মার্কিন আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আর তার পরিণতি কী হয়েছিল, তা শুরুতেই বলা হয়েছে। 

আরও পড়ুন
সুড়ঙ্গের ভিতরে ২৭০টি মৃতদেহ! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন ফ্রান্সে

যুদ্ধবিমানে বিয়ার ফেরির এই ঘটনা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ব্রিটেনে যে, নরম্যান্ডি রণক্ষেত্রের ফ্রন্টলাইনে বিয়ারের সরবরাহ বজায় রাখতে আলাদা তহবিলও গড়ে তুলেছিল অন্যান্য ব্রিটিশ ইউনিটগুলি। এমনকি ব্রিটেনের সাধারণ পুলিশ বিভাগের কনস্টেবল এবং হেইনাররা বিনামূল্যে বিয়ার দান করতেন সৈন্যদের জন্য। আর বিয়ার পরিবাহী সেই বিমানগুলি? তারা অবিলম্বেই ‘উড়ন্ত পাব’-এর আখ্যা পায়।

বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও ব্রিটিশ বায়ুসেনাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বিয়ার পরিবহনের এই রীতি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই খবর পৌঁছে যায় ব্রিটেনের কাস্টম অ্যান্ড এক্সাইজ মন্ত্রকের কাছে। কড়া পদক্ষেপ নেয় ব্রিটেন প্রশাসন। আইন করেই বন্ধ করে দেওয়া হয় এই বিয়ার ফেরি। অবশ্য ততদিনে চালু হয়ে গেছে অফিসিয়াল শিপমেন্ট। সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ হয়েছে কার্গোও। আর বিশ্বযুদ্ধও যে শেষ। ধীরে ধীরে দেশে ফিরছে সমস্ত সেনারাই। ফলে ‘ফ্লাইং পাব’-এর প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায় চিরতরে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More