দেখলে মনে হবে, স্বচ্ছ এক টুকরো কাচের খণ্ড। কিন্তু আদতে তা নয়। বরং, এই ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে ২৫৬ বছর পুরনো আন্টার্কটিক বরফ থেকে। আর এই চোঙাকার ভাস্কর্যের সমস্ত নকশাই তৈরি হয়েছে বাতাস দিয়েই। হ্যাঁ, অবাক লাগলেও সত্যি। সম্প্রতি এমনই এক অভিনব শিল্প তৈরি করে দেখালেন ব্রিটিশ শিল্পী ওয়েন বিনিতি (Wayne Binitie)।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতেই এমন অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন বিনিতি। সম্প্রতি, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে আয়োজিত হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কোপ-২৬ (COP-26)। এই সম্মেলনেই ‘পোলার জিরো’ প্রদর্শনীতে বর্তমানে প্রদর্শিত হচ্ছে ওয়েন বিনিতির তৈরি মেরু-বাতাসের শিল্পকলা ‘১৭৬৫— আন্টার্কটিক এয়ার’ (1765- Antarctic Air)।
হ্যাঁ, এমনই অদ্ভুত নাম সংশ্লিষ্ট ভাস্কর্যটির। কিন্তু হঠাৎ এমন নামকরণের কারণ কী? বুঝতে গেলে ফিরে যেতে হবে আড়াইশো বছর। ১৭৬৫ সালেই কিংবদন্তি স্কটিশ বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক জেমস ওয়াটের হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল বাষ্পীয় ইঞ্জিন। পরবর্তীতে যা শিল্পের ক্রমবর্ধমান বিকাশের মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ফলত, এই বছরেই শিল্প বিপ্লবের সূচপাত হয়েছিল বলেই ধরে নেন ঐতিহাসিকদের একাংশ।
স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর থেকেই গোটা বিশ্বজুড়ে এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছিল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। আর সেইসঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বায়ুতে কার্বনের মাত্রাও। পরিসংখ্যান বলছে, সেসময়ে বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ছিল প্রতি মিলিয়নে মাত্র ২৮০ ভাগ। ১৯৬০-এর দশকে তা পৌঁছায় ৩১৫-তে। তারপর প্রায় লাফিয়ে বেড়ে বর্তমানে সেই সংখ্যাটা ৪১৫। এভাবে চলতে থাকলে খুব বেশিদিন বাকি নেই মেরু প্রদেশের সমস্ত বরফ ফলে যেতে। ঠিক এই বার্তা তুলে ধরতেই এমন অভিনব প্রয়াস রয়্যাল কলেজ অফ আর্ট-এর পিএইচডি স্কলার ও শিল্পী বিনিতির।
আরও পড়ুন
ভুয়ো খবর রুখতে পরিবেশ বিষয়ক তথ্যভাণ্ডার তৈরি ফেসবুকের
দেখতে গেলে, স্বাভাবিকভাবে আন্টার্কটিকায় বরফ গলে না। বরং, ক্রমশ তুষারপাতের ফলে বাড়তে থাকে বরফের আস্তরণ। সেই বরফের চাদরে ড্রিল করেই ১১০ মিটার গভীর থেকে তুলে আনা হয়েছিল একটি বরফ খণ্ড। তারপর তরল সিলিকনের মধ্যে বন্দি করা হয়েছিল মেরুপ্রদেশের ‘বিশুদ্ধতম’ বাতাস। বরফ খণ্ডের মধ্যে সেই বাতাসের মাধ্যমেই অভিনব নকশা ফুটিয়ে তুলেছেন বিনিতি।
আরও পড়ুন
২০২০ সালে পরিবেশ-সংক্রান্ত অপরাধ বেড়েছে ৭৮.১ শতাংশ
তবে শুধু দর্শনীয়ই নয়। চাইলেই ছুঁয়ে দেখা যাবে অভিনব এই ‘মেরু-শিল্প’। শোনা যাবে তার শব্দও। কোপ-২৬ সম্মেলনীতে একটি সুবিশাল কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে এই ভাস্কর্যটিকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ ধীর গতিতে গলছে সেটাই। আর সেই বরফ-গলা জল সঞ্চিত হচ্ছে অন্য একটি ভিন্ন চেম্বারে। প্রতি ফোঁটা জল পড়ার ফলে চোঙাকার বরফপাত্রে প্রবাহিত হচ্ছে মেরুবায়ু। তৈরি করছে শব্দ। সেইসঙ্গে জলের ফোঁটা পড়ার আওয়াজ মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত রহস্যময় আবহ গড়ে তুলছে গ্লাসগো-র এই প্রদর্শনীকক্ষে।
আরও পড়ুন
বিরল তুষারপাত ব্রাজিলে, বরফে ঢাকা পড়ল ৪৩টি শহর
জাতিসংঘের মতো সংস্থার ‘জলবায়ু পরিবর্তন’-এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই সম্মেলন আয়োজিত হওয়ায় আলাদা মাত্র পেয়েছে বিনিতির তৈরি ভাস্কর্যটি। এখন দেখার এই ভাস্কর্যে অন্তর্নিহিত বার্তা কতটা সচেতন করে তুলতে পারে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির শাসকদের…
Powered by Froala Editor