যে দেশটাকে ছাড়া ফুটবলের কথা কল্পনাতেও আনা যায় না, তা হল ব্রাজিল (Brazil)। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপের জন্মলগ্ন থেকেই নিরবছিন্নভাবে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চলেছে লাতিন আমেরিকার দেশটি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কাপ জেতার রেকর্ডও তাদের ঝুলিতেই। ভারত তো বটেই, বিশ্বের যে-কোনো ফুটবল-পাগল দেশেই অনায়াসেই খুঁজে পাওয়া যায় সবুজ-হলুদ সমর্থক। তবে মজার বিষয় হল, যে হলুদ রং লাতিন আমেরিকার ফুটবল পাওয়ার হাউসের প্রতীক, ঐতিহ্য কিংবা গর্ব— জন্মলগ্নে সেই দল খেলত সাদা জার্সি (White Jersey) পরে।
হ্যাঁ, শুনতে একটু অবাক লাগলেও সত্যি। বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকে সাদা জার্সিই ছিল ব্রাজিলের প্রতীক। এমনকি সাদা জার্সি পরেই ১৯১৯ সালে কোপা আমেরিকায় জয়যাত্রা শুরু করেছিল পেলে, সক্রেটিস, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, নেইমারের দেশ। কিন্তু হঠাৎ করে কেন বদলে গেল জার্সির রং?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে ৭২ বছর। সেবার বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল ব্রাজিলেই। তবে শুধু স্বাগতিক দেশই নয়, সে-বারের টুর্নামেন্ট ফেভারিটও ছিল ব্রাজিল। আসলে ১৯৩০ সাল থেকে বিশ্বকাপ খেললেও, ১৯৩৮ পর্যন্ত কোনোবারেই সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি ব্রাজিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফুটবলের দুনিয়ায় স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন করে ব্রাজিল। ততদিনে যেমন উঠে এসেছে এক ঝাঁক নতুন তারকা, তেমনই ফুটবল হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।
১৯৫০-এর সেই বিশ্বকাপে নক-আউট ম্যাচ ছিল না কোনো। ছিল না ফাইনাল-ও। বরং, পরীক্ষামূলকভাবে সেভাবে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করে রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে। সর্বোচ্চ পয়েন্ট সংগ্রহকারী দলই হবে বিশ্বকাপ-বিজেতা, জানিয়েছিল ফিফা। এই প্রতিযোগিতায় প্রথম থেকে নজরকাড়া ফর্ম মেলে ধরলেও, শেষ ম্যাচে গিয়ে বিপত্তি বাঁধায় সেলেকাওরা। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে সেদিন তারা খেলতে নেমেছিল মারাকানা স্টেডিয়ামে। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের থেকে দূরত্ব মাত্র ১ পয়েন্ট। অর্থাৎ, ড্র করলেই জয় নিশ্চিত।
কানায় কানায় সেদিন ভর্তি ছিল মারাকানা। সবমিলিয়ে সেদিন হাজির ছিল ১ লক্ষ ৭৩ হাজার দর্শক। অবশ্য বেসরকারি নথি অনুযায়ী, সংখ্যাটা ছাপিয়ে গিয়েছিল ২ লক্ষের সীমা। মানে ফাইনাল না থাকলেও, এই ম্যাচটিকেই ফাইনালের সমতুল্য বলে ধরে নেওয়া যায় অনায়াসেই।
সেদিন শুরু থেকেই ম্যাচের চালকের আসনে ছিল ব্রাজিল। ম্যাচের ৪৭ মিনিটেই ফ্রিয়াসার গোলে এগিয়েও যায় সেলেকাওরা। তবে তার মিনিট কুড়ি বাদেই সমতা ফেরায় উরুগুয়ে। ৬৬ মিনিটে এই গোল খাওয়ার পরেই ছন্দপতন হয় ব্রাজিলের। খেই হারিয়ে ফেলে গোটা দল। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আরও একটি গোল হজম করতে হয় তাদের। আলসিডেস ঘিঘিয়ার সেই গোল মুহূর্তে নিস্তব্ধতায় ঠেলে দিয়েছিল মারাকানাকে।
১৯৫০ বিশ্বকাপের এই ম্যাচটিকে ব্রাজিল তো বটেই, গোটা ফুটবল ইতিহাসের অন্ধকারতম দিন বললেও ভুল হয় না এতটুকু। সেদিন আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্রাজিল। কাপ উঠেছিল উরুগুয়ের হাতে। অন্যদিকে মারাকানার স্টেডিয়াম থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন এক ব্রাজিল সমর্থক। শোক সহ্য করতে না পেরে হৃদরোগে মৃত্যু হয় আরও তিন জনের।
মারাকানা ট্র্যাজেডি খ্যাত এই আশ্চর্য ঘটনার পর থেকেই গোটা ব্রাজিলে ক্ষোভ তৈরি হয় সাদা জার্সির ওপর। সংবাদমাধ্যমেও লেখা হতে থাকে, ব্রাজিলের এই পরাজয়ের অন্যতম কারণ তাদের সাদা জার্সি। সেটি নাকি ‘অপয়া’। পরিস্থিতির চাপে এই জার্সি বদলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনও। নতুন জার্সির জন্য তারা আয়োজন করেছিল একটি প্রতিযোগিতা। সেখানেই হলুদ জার্সিটির নকশা জমা দেন এক তরুণ ফুটবল সমর্থক।
খুব আহামরি নকশা নয়। সাদামাটা হলুদ জার্সি। বুকের ওপর ছোট্ট করে আঁকা ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের লোগো। জামার হাতায় নীল বর্ডার ও সবুজ কলার। সেই ফুটবল কিটের প্যান্টের রং-ও ছিল নীল। অর্থাৎ, বলতে গেলে সার্বিকভাবে সাদা বর্জন করে ব্রাজিল। ১৯৫৪-এর বিশ্বকাপ থেকে এই জার্সি পরেই মাঠে নামে ব্রাজিল। সেবারও কাপ পাওয়া হয়নি ঠিকই। তবে ১৯৫৮ সালেই প্রথম সাফল্য পায় ব্রাজিল।
মজার বিষয় হল, সেবারে ব্রাজিলকে ফাইনাল খেলতে হয়েছিল সুইডেনের বিরুদ্ধে। ঘরের মাঠে হলুদ জার্সি পরেই খেলবে তারা, এমনটাই জানিয়ে দিয়েছিল সুইডিস ফুটবল ফেডারেশন। বিপাকে পড়েছিলেন পেলেরা। হলুদ জার্সির সঙ্গে সাদা জার্সিও ছিল বটে তাঁদের সঙ্গে। তবে দ্বিতীয়বার কি আর একই ভুল করা যায়? বাজার থেকে তড়িঘড়ি নীল জামা কিনে তাতে ব্রাজিলের লোগো সেলাই করে তৈরি করা হয়েছিল জার্সি। সুইডেনের মাটিতেই। আর সেই জার্সি গায়ে দিয়েই প্রথম বিশ্বকাপের স্বাদ নেয় সেলেকাওরা। ৫-২ গোলে বিধ্বস্ত করে সুইডিসদের।
এরপর পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি দশক। বিশ্বকাপের ময়দানে বার বার হলুদ জার্সিতেই ফুল ফোটাতে দেখা গেছে সেলেকাওদের। সাদা জার্সিটি আর ব্যবহৃত হয়নি কোনোদিন। এমনকি বছর কয়েক আগে পর্যন্ত কোপা আমেরিকাতেও ব্রাত্য ছিল এই ‘অপয়া’ জার্সি। ২০১৯ সালে প্রথম কোপা-জয়ের ১০০ বছর পূর্তিতে ফের নতুন করে প্রত্যাবর্তন করে সাদা জার্সিটি। ভিনিসিয়াস জুনিয়ারের হাতে ঘটা করেই এই জার্সির উদ্বোধন করে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন। তবে আজও মলিন হয়নি তার কুখ্যাতি…
Powered by Froala Editor