সাল ১৯৫৪। কয়েক বছর আগে দেশভাগের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হয়েছে দুটি রাষ্ট্র। পূর্ব পাকিস্তানের বুকে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য লড়াই। ১৯৫২ দেখেছে কিছু তরুণ তাজা প্রাণের মৃত্যু। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ও সেনার অত্যাচারে অতিষ্ঠ তাঁরা। এরই মধ্যে ঢাকায় শুরু হল ন্যাশনাল অলিম্পিক। সেদিন ছিল সাঁতারের ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল ইভেন্টের ফাইনাল রাউন্ড। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেখানকার সেরা সাঁতারুরা অংশ নিয়েছেন। তাঁদেরই মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক বাঙালি যুবক। ঢাকার বিক্রমপুরের ছিপছিপে শ্যামলা গ্রাম্য যুবকটি শত বাধা টপকে এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন। জল যেন একপ্রকার যুদ্ধের ময়দানই। যে করেই হোক, জিততেই হবে…
দিনের শেষে সকলকে পিছনে ফেলে প্রথম হন সেই যুবক। ঢাকার এক বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের সাঁতারুদের হারিয়ে দেবে— এটা যেন মানতে পারলেন না সেখানকার বিচারকেরা। নানা অজুহাত দেখিয়ে যুবককে অযোগ্য ঘোষণা করলেন, বাদ দেওয়া হল তাঁকে। আবারও উঠল প্রতিবাদের ঝড়। সব জায়গায় বাঙালিদের প্রতি এরকম অন্যায় অত্যাচার কেন মেনে নেওয়া হবে? প্রতিবাদের তেজে আবারও আয়োজিত হল প্রতিযোগিতা। এবারও জিতলেন সেই যুবক। এবার আর সরানো যায়নি তাঁকে। এখান থেকেই শুরু হল এক কিংবদন্তির গল্প। ঢাকার সেই যুবক কালে কালে নিজেকে ছাপিয়ে এগিয়ে যাবেন আরও আরও দূরে। ব্রজেন দাস যেন তৈরিই হয়েছিলেন ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য।
বাংলার গ্রামে গ্রামে বেড়ে ওঠা কিশোর যুবকদের কাছে সাঁতার যেন সহজাত। কখনও পুকুরে, কখনও বাড়ির পাশের নদীতে চলত দাপাদাপি। এই করেই তৈরি হয়ে যায় হাত পা। কেউ কেউ ডুব সাঁতার অবধিও চলে যায়। সেইভাবেই জীবনটা শুরু হয়েছিল ব্রজেন দাসের। বুড়িগঙ্গা নদী ছিল প্রাথমিক পাঠশালা। সেখানেই ছোটো থেকে সাঁতারের হাতেখড়ি। তবে অন্যান্যদের মতো নেহাত শখে থেমে যায়নি যাত্রাটা। জল কাটিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যাবার নেশা যেন পেয়ে বসেছিল তাঁকে। সেখান থেকেই ন্যাশনাল অলিম্পিকের মঞ্চ। সোনা জয়ের পর লক্ষ্যটা আরও বেড়ে যায়। এর আগে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলেও প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকার লড়াইয়ের গণ্ডিটা আরও বড়ো ছিল…
১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে ফ্রি-স্টাইল প্রতিযোগিতার শেষ কথা ছিলেন ব্রজেন দাস। যেখানেই নেমেছেন, জিতে ফিরেছেন। ১৯৫৫ সালের ন্যাশানাল অলিম্পিকেও দুটো ইভেন্টে সোনা জেতেন। পরের বছরই মেলবোর্ন অলিম্পিক। ক্রীড়াবিদদের স্বপ্নের জায়গা। ব্রজেন দাস স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন। শুধু স্বপ্ন দেখাই নয়, দিনরাত এক করে চলছে অনুশীলন। আশা, জাতীয় দলে জায়গা পাবেনই। কিন্তু বাঙালি সাঁতারুর ‘স্পর্ধা’ তখনও হজম করতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তান সরকার। অতএব, অলিম্পিকের চূড়ান্ত দলে জায়গা পেলেন না ব্রজেন দাস। অলিম্পিকের স্বপ্ন ভেঙে খানখান!
১৯৫৭ সাল। বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে সেবার ঢাকায়। তাঁর মধ্যেই কেউ কেউ লক্ষ করলেন, কে যেন এই প্রবল ঠান্ডার মধ্যেও সুইমিং ক্লাবে প্র্যাকটিস করছেন। পাগল ভেবেছিলেন তাঁরা। সত্যি একপ্রকার পাগলই ছিলেন ব্রজেন দাস। মনের মধ্যে তীব্র হচ্ছে জেদ। অলিম্পিকে জায়গা পাননি তো কী হয়েছে, ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে তৈরি করবেন। সাঁতারের আন্তর্জাতিক জগতে বাঙালির পতাকা ওড়াবেন। লক্ষ্য বদলে গেছে তখন। মাথায় ঘুরছে একটাই নাম— ইংলিশ চ্যানেল। সাঁতারের জগতে এর মাহাত্ম্য কী সেটা আলাদা করে বলার দরকার পড়বে না। সেখানেই এবার নামতে চান ব্রজেন। আর তার জন্যই প্রবল ঠান্ডার মধ্যেও চলছে প্রস্তুতি।
ব্রজেন দাসের এই উদ্যোগের কথা একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল পূর্ব পাকিস্তানে। তিনিও সহযোগিতা চাইলেন ঘনিষ্ঠ মহলে। যদি ব্রজেন সফল হন, তাহলে সেটা মহান কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এর আগে দক্ষিণ এশিয়া থেকে কেউ ইংলিশ চ্যানেল পার করেননি। একজন বাঙালি হয়ে সেই কৃতিত্ব অর্জন করলে সেটাই হবে আসল জবাব। সেখানেই জয় হবে বাংলার। তড়িঘড়ি তৈরি হল চ্যানেল ক্রসিং কমিটি নামের একটি বিশেষ কমিটি। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান থেকে আরম্ভ করে সাংবাদিক, ক্রীড়া সংগঠক— সবাই এগিয়ে এলেন তাঁর সাহায্যে। পাকিস্তান সরকার তো অর্থসাহায্য করবে না। কাজেই শুরু হল চাঁদা তুলে ফান্ড জোগাড় করা। শেষমেশ এস এ মহসিন এবং মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন ব্রজেন দাস। লক্ষ্য স্থির, অবিচল…
আরও পড়ুন
প্রয়াত বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আলোকচিত্রী সাইদা খানম
তারপর এল ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট। ২৩টি দেশের প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল জয় করলেন ব্রজেন দাস। ১৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিটের দূরত্ব কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে অনেক স্কুল, কলেজ একদিনের জন্য ছুটি দেওয়া হয়েছিল এইজন্য। অবশ্য একবার নয়, ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে মোট ছয়বার ইংলিশ চ্যানেল জয় করেন তিনি। দেশে ফেরার পর যে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে অবমাননা জুটেছিল, তারাই তাঁকে সম্মানিত করে। আইয়ুব খান রীতিমতো বুকে জড়িয়ে ধরেন তাঁকে।
‘বাংলার আবার এপার ওপার হয় নাকি!’ এই কথাটা ব্রজেন দাসেরও বারবার মনে হয়েছিল। অনেক জায়গায় বলেওছেন তিনি। তাঁর পরিচয় ‘বাঙালি’; যার জীবন শুরু হয়েছিল ঢাকায়, শেষ হয় কলকাতায়। মাঝখানের বছরগুলোয় একজন কিংবদন্তির আরও কৃতিত্ব স্থাপনের সময়। ১৯৬১ সালে কুইন এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করার সময়ও বাঙালির জয়ই দেখেছিলেন তিনি। তাঁর বাংলার নদী যে লড়তেই শিখিয়েছে তাঁকে!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
তৈরি করলেন পাখা টানার মেশিন, সেটাই হয়ে গেল ভারতের প্রথম পেটেন্ট অ্যাপ্লিকেশন