১৯৮৫ সালের ১৫ এপ্রিল। দিনটা এখনও স্মরণীয় বক্সিং-প্রেমীদের কাছে। একদিকে ‘হিটম্যান’ থোমাস হার্নস, অন্যদিকে তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন মার্ভিন হ্যাগলার। বক্সিং ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের যুদ্ধক্ষেত্র। হ্যাঁ, যুদ্ধক্ষেত্রই বটে। কারণ সেই ম্যাচ পরিচিত ‘দ্য ওয়ার’ নামে। তবে তিন রাউন্ড মিলিয়ে মাত্র ৮ মিনিট ১ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল সেই যুদ্ধ। প্রথম দুই রাউন্ডে মাথায় গভীর ক্ষত, রক্তক্ষরণ এমনকি ভাঙা ডান হাত নিয়েও লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন মার্ভিন হ্যাগলার। আর শেষ রাউন্ডে একটা ঘুঁষিতেই বাজিমাত। সরাসরি নক-আউট। নব্বই-এর দশক তো বটেই, একুশ শতকের প্রথম দশকেও বক্সিংয়ের এক নম্বর ম্যাচ হিসাবেই বিবেচিত হত এই লড়াই।
কিংবদন্তি বললেও বোধ হয় কম বলা হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭— একটানা আট বছর বিশ্বচ্যাম্পিয়নের তকমা ধরে রেখেছিলেন তিনি। বক্সিং রিংয়ে একের পর এক তৈরি করেছেন রূপকথার মতো জয়গাথা। তবে জীবনের কাছে শেষমেশ হার মানলেন তিনি। ৬৬ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ‘মার্ভেলাস’ মার্ভিন হ্যাগলার। গতকাল তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানান তাঁর স্ত্রী। ঘোষণা করা হয় হ্যাম্পশায়ারে নিজের বাড়িতে ১৩ তারিখ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন কিংবদন্তি। তবে পরিষ্কার করে জানানো হয়নি মৃত্যুর কারণ।
১৯৫৪ সালে নিউজার্সির সেন্ট্রাল ওয়ার্ডে জন্ম মার্ভিনের। যখন তেরো বছর বয়স, নিউজার্সিতে হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল রায়টের আগুন। মারা গিয়েছিলেন ২৬ জন। ধ্বংস হয়েছিল বহু নির্মাণ। বাস্তচ্যুত হয়ে ম্যাসাচ্যুসেটে আস্তানা নিয়েছিলেন মার্ভিন। সেখানেই সাক্ষাৎ হয় স্ট্রিট-ফাইটারদের সঙ্গে। লড়াইয়ের কৌশল আয়ত্ত করে নিজে বেশ কিছু ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন তিনি। বলাই বাহুল্য তাতে সাফল্য এসেছিল ভাবনাতীত। আর তারপরেই বক্সার হওয়ার সিদ্ধান্ত।
তবে ১৬ বছর বয়স না হলে যে কিছুতেই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারবেন না তিনি। কাজেই মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় জন্মসালের জায়গায় লিখলেন ১৯৫২। ১৯৮৫ সালে তাঁর নাম পরিবর্তনের সময় আদালতে পেশ করা নথি থেকেই প্রকাশ্যে এসেছিল সেই ঘটনা। ১৯৬৯ সালে সেই পেশাদার বক্সিংয়ের রিং-এ প্রথম পা দেওয়া। তারপর রাজত্ব এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। তৈরি করা সোনায় বাঁধানো এক মহাকাব্যের।
আরও পড়ুন
কেরিয়ারের শুরুতেই হারিয়েছেন মহম্মদ আলিকে, প্রয়াত মার্কিন বক্সার লিওন স্পিংকস
সব মিলিয়ে মোট ৬৭টি আন্তর্জাতিক মানের ম্যাচ খেলেছেন হ্যাগলার। তার মধ্যে জয় এসেছিল ৬২ ম্যাচে। ৩টি মাত্র ম্যাচে হার। ২টি অমীমাংসিত। এমন ট্র্যাকরেকর্ড বক্সিংয়ের ইতিহাস বিরল। পাশাপাশি ৬২টি জয়ের মধ্যে ৫২টিতেই প্রতিপক্ষকে নকআউট করেছেন তিনি। অর্থাৎ ৮৩ শতাংশ জয় নকআউটের মাধ্যমে। বক্সিংয়ের ইতিহাসে এই হারের ধারে কাছে নেই কেউ-ই। এমনকি ‘ঈশ্বর’ মহম্মদ আলিও।
সব মিলিয়ে ১২টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের বেল্ট রয়েছে তাঁর পকেটে। যার মধ্যে রয়েছে ৮ বছরের টানা রাজত্ব। ১৯৮৭ সালে সুগার লিওনার্ডের কাছে বিতর্কিত হারের পরই ইতি টেনেছিলেন মাত্র ১৪ বছরের ক্রীড়াজীবনে। লড়ে যাওয়ার সামর্থ্য কি ছিল না তখনও? তবে সরে এসেছিলেন নিজেই। তারপর প্রায় জনপ্রিয়তার আড়ালেই কাটিয়েছেন বাকি জীবন। অত্যন্ত সাদামাটাভাবে। প্রাক্তন হ্যাভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন লেনক্স লিউয়িসের স্মৃতিচারণাতেও উঠে আসে সেই কথাই। বক্সিং রিংয়ের বাইরে তেজস্বী সেই মানুষটা যে এতটাই সরল হতে পারেন, তা না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয় কারোর পক্ষেই।
আরও পড়ুন
মাত্র ২২ বছর বয়সে ঘোষণা ‘আমিই আমেরিকা’, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার মহম্মদ আলি
পেয়েছেন বক্সিংয়ের ‘হল অফ ফেম’। আশির দশকে সেরা বক্সিং তারকা হিসাবেও তাঁর নাম ঘোষণা করেছিল ‘বক্সিং ইলাস্ট্রেটেড’ পত্রিকা। তাছাড়াও ২০০২ সালে বিগত ৭০ বছরের সেরা বক্সারদের তালিকায় ১৭তম স্থানে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল তাঁর নাম। এককথায় রিং ছাড়ার বহু বহু বছর পরেও তাঁর জায়গাটা আজও দখল করতে পারেনি কেউ। মৃত্যুতে চিরকালীন এক শূন্যস্থান তৈরি করে রেখে গেলেন তিনি। শেষ হল বক্সিংয়ের এক সোনালি অধ্যায়…
Powered by Froala Editor