চামড়ায় বাঁধানো বই কিংবা ডায়েরির ব্যবহার জীবনেও কখনো করেননি, এমন মানুষ বিরল। তবে সেই চামড়ার উৎস বোঝাতে যদি কসাইখানার দৃশ্য দেখানো হয় তবে ঘিনঘিন করে উঠবে গা। তবে বাস্তবে তো তেমনটাই সত্যি। কিন্তু সেই চামড়া যদি মানুষের হয় তাহলে? শুনলে ঠাণ্ডা স্রোত প্রবাহিত হবে শিরদাঁড়া বেয়ে। কারণ অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ জিনিস অবাস্তব নয় একেবারেই। রয়েছে প্রমাণও।
বছর পাঁচেক আগের কথা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করা একটি বই নিয়েই শোরগোল পরে গিয়েছিল রীতিমতো। ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে জানা যায়, সেই বই নাকি বাঁধানো হয়েছে মানুষের চামড়ায়। তবে এমন একটা বিষয় নিয়ে বিতর্ক থাকবে না, তা কি হয়?
তবে সেই বিতর্কের রেশ টেনেছিলেন বিজ্ঞানীরা। পিএমএফ, ম্যাট্রিক্স-অ্যাসিস্টেড লেসার ডিসর্পশন পদ্ধতিতে প্রমাণ দিয়েছিলেন সেই চামড়া আসলে মানুষের। তবে এখানেই শেষ নয়। এই আবিষ্কারের পরে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে আসে সারা পৃথিবীর মোট ৫০টি বই। দাবি ওঠে সেগুলিরও ওপরের মলাট তৈরি মানুষের চামড়ায়। তবে ২০১৯ সালের শেষে পরীক্ষার পরে দেখা গিয়েছিল তার মধ্যে ১৮টির ক্ষেত্রে সত্যি এই ঘটনা। এমনকি এই বইগুলির মধ্যে রয়েছে জন মিল্টনের একটি কবিতার বইয়ের সংস্করণও। বাকিগুলো কোনো গবাদি পশুর চামড়াতেই তৈরি।
তবে সময়ের নিরিখে আরও একটু পিছিয়ে গেলে, এই ঘটনাকে আর অস্বাভাবিক লাগবে না। অষ্টাদশ কিংবা উনবিংশ শতকে বহু অঞ্চলে বহুল প্রচলিত ছিল এই রীতি। যাকে বলা হয় ‘অ্যানথ্রোপোডারমিক বিবলিওপেগি’। তবে ধীরে ধীরে এই প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বিশ শতকের শুরুর দিকেও কোথাও কোথাও ব্যবহৃত হত এই ঘৃণ্য বই-বাঁধাইয়ের পদ্ধতি।
পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো সর্বশেষ বই হিসাবে এখনও অবধি বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন ফরাসি লেখক আর্সেন হুসেইয়ের একটা বই। উল্লেখ্য, হার্ভার্ডের গ্রন্থাগারে পাওয়া বইটি এটিই। বইটি লেখা হয়েছিল ১৮৮০-র দশকের শেষ দিকে। বিষয়বস্তু ছিল মৃত্যু পরবর্তী পরলৌকিক জীবন, মানুষের আত্মার গন্তব্যের ওপরে। চিকিৎসক বন্ধু লুডোভিক বুল্যান্ডকে সেই বই উপহার দিয়েছিলেন আর্সেন। পরবর্তীকালে ‘ডেসটিনি অফ দ্য সোল’ নামের সেই বইয়ের বাঁধাই করেন তিনিই। মৃত এক মানসিক রোগীর চামড়াকে ট্যান করেন নিজেই। তারপর তৈরি হয় বইয়ের মলাট। বিশ শতকের একদম শুরুর দিকে।
জানা যায়, নৃশংস পদ্ধতিতেই করা হত অ্যানথ্রোপোডারমিক বিবলিওগ্রাফি’। জীবন্ত মানুষের চামড়াও উপড়ে ফেলা হত বিনা-দ্বিধায়। তারপর সেখানেই লেখা হত বই কিংবা উইল। রয়েছে এমন উদাহরণও। ঔপনিবেশিক যুগে কোথাও কোথাও আবার নিগ্রো বিপ্লবী নেতার পিঠের চামড়া ছিঁড়ে সেখানেই লেখা হয়েছে সাবধানবাণী।
আরও পড়ুন
বন্ধের মুখে ঐতিহ্যবাহী বই-বিপণী ‘শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি’, পাশে দাঁড়ালেন পাঠকরাই
তবে এই প্রথার দিক থেকে দেখতে গেলে সবথেকে কুখ্যাতি ছিল ফ্রান্সের। ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে যেদিকেই চোখ যায় মানুষের মৃতদেহ। আর সেই মৃতদেহের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাই তো দূরের কথা, পোশাকও বানানো হত। ১৭৯৪ সালে তৎকালীন ফরাসি সরকার স্বয়ং মিউদোঁ গ্রামে আয়োজন করেছিল একটি অনুষ্ঠানের। সেখানে রাজবেশে সজ্জিত এক যুবতীর হত্যার পর তাঁর চামড়া দিয়ে তৈরি হয়েছিল স্মারক। উনিশ শতকেও ওই অঞ্চলে এমন কিছু ট্যানারির অস্তিত্ব ছিল, যেখানে পেশাগতভাবে ট্যান করা হত মানুষের চামড়া। ফুঁকোর লেখাতেও এসেছে এই ধরণের বইয়ের প্রসঙ্গ। ‘বার্থ অফ দ্য ক্লিনিক’ বইতেও তিনি উল্লেখ করেছেন ফরাসি চিকিৎসকরা হামেশাই মৃত রোগীদের চামড়া সংরক্ষণ করতেন। ব্যবহার করতেন লেখা কিংবা বই বাঁধাইয়ের কাজে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, এই প্রথা দোষের নয় মোটেই।
তবে ধীরে ধীরে যত এগিয়েছে সভ্যতা, এই বর্বর প্রথাকে বর্জন করেছে মানুষ। মানুষের চামড়ায় বাঁধানো অধিকাংশ বই-ই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে। এক অর্থে ধুঁকতে থাকা ঔপনিবেশিক শাসনকালে মুছে দেওয়া হয়েছিল নৃশংস ইতিহাসকে। শাসকদের স্বার্থেই। তবে তারপরেও টিকে রয়েছে কিছু উদাহরণ। বৈধতা হারানোর পরেও লোকচক্ষুর আড়ালে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এই ধরণের বাঁধাইয়ের কাজ করেছেন। তারই এক উদাহরণ হার্ভার্ডে সংরক্ষিত বইটি এবং আরও ১৭টি বই। যা ধরে রেখেছে অন্ধকার যুগের মানুষের চিন্তাভাবনার প্রতিফলনকে। ইতিহাসের খণ্ডচিত্র হয়ে বেঁচে থাকা সেই বইগুলি হাতে নিলে এখনও শিউরে উঠবে যে-কেউ...
তথ্যসূত্র-
১. Anthropodermic bibliopegy, Wikipedia
২. Harvard University book bound in human skin, BBC
৩. Tanneries of human skin? Meudon, Rodama1789 Blog, Rodama
৪. Anthropodermic Bibliopegy – A Flay on Words, Odd Things Considered,
৫. Lullaby by Chuck Palahniuk, Wikipedia
আরও পড়ুন
কেনার প্রয়োজন নেই, দেশ-বিদেশের বই 'ভাড়া' পাবেন কলকাতার এই ফুটপাথেই
Powered by Froala Editor