চা-কফি-স্টার্টারের পাশেই বইয়ের স্টল, বৌভাতে অভিনব আয়োজন বাঙালি যুবকের

বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান। ঘর ভর্তি অতিথিদের ভিড়ে। বর-কনে দুজনেই বসে আছেন যথাস্থানে। অবশ্য ঠিক বিয়ে নয়, বৌভাত। আশেপাশে রয়েছে কফি, পকোড়ার স্টল। কিন্তু কিছু যেন আলাদা ঠেকছে। কিছু যেন অভিনব। পরে ঠিকই ধরা পড়ল সেই ‘অদ্ভুত’ আয়োজনের। ঘরের একটি কোণে টেবিল জুড়ে রাখা আছে বই! হ্যাঁ, খাবার দাবারের পাশাপাশি বিয়েবাড়িতে বইয়েরও সম্ভার। চাইলে লোকজন কিনতেও পাচ্ছে সেটা। এমনই অভিনব উদ্যোগ কলকাতার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের। তাঁদেরই ছেলে ঋতায়নের বৌভাতের আসরের এই ঘটনাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে সম্প্রতি।

আরও পড়ুন
বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বই সংগ্রহ, পৌঁছে দেন দুঃস্থ পড়ুয়াদের কাছে – দিনবদলের লড়াই সন্দীপের

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ঋতায়ন চট্টোপাধ্যায় ছোটো থেকেই ছিলেন আপাদমস্তক বইপোকা। যখন যা বই পেতেন, পড়ে ফেলতেন। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এক অদম্য প্রেম। যত বড়ো হচ্ছিলেন, ততই যেন তাকগুলো ভরে যাচ্ছিল। এমন অবস্থা হয়, তাঁর নিজের ঘরের অর্ধেকেরও বেশি জায়গায় ছড়ানো ছেটানো বিভিন্ন বই। অবশ্য এটা শুধু একা ঋতায়নের ‘ব্যামো’, তা নয়। বইপোকা হওয়াটা যেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের জিনগত ব্যাপার। কথাপ্রসঙ্গে সেটাই বলছিলেন ঋতায়নের বাবা ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়। “আমার বাবা, মানে ওঁর দাদু ছিলেন অসম্ভব বইয়ের ভক্ত। অফিসে কাজ করার সময় ছাড়া প্রায় সারাক্ষণই বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতেন। তন্ময় হয়ে পড়তেন, যেন সাধনা। এমনকি, রাস্তা দিয়ে যখন যেতেন, তখনও ছাড়তেন না বই। বাগবাজারে থাকাকালীন, পাড়ার সবাই বাবাকে চিনত ‘বই পড়তে পড়তে যাওয়া লোক’ হিসেবে। একটা সময় চোখের সমস্যাও দেখা দেয়, মোটা চশমা ওঠে। তাও পড়া বন্ধ হয়নি। সেই রোগ আমার মধ্যে তো বটেই, আমার ছেলে ঋতায়নের ক্ষেত্রেও সংক্রামিত হয়েছে।”

আরও পড়ুন
ভাড়া পাওয়া যায় বইও, কলকাতার ‘অজানা’ দোকানগুলি পাঠকের খিদে মেটাচ্ছে এভাবেই

এমন বইপাগল ঋতায়ন যখন নিজের চারিদিকে দেখতেন, তখন বেশ হতাশই হতেন। বই পড়ার সেই যে রেওয়াজ, সেই যে আগ্রহ, সেটা কেমন যেন কমে যাচ্ছে। কম্পিউটারে, মোবাইলে পড়া একরকম। কিন্তু হাতে বই নিয়ে পড়ার যে আনন্দ, নতুন বইয়ের যে মাতিয়ে দেওয়া ঘ্রাণ, সেটা তো পাচ্ছি না আমরা। সেখান থেকেই অভিনব একটি ভাবনা মাথায় এল ওঁর। বর্তমানে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক ঋতায়ন সেই পরিকল্পনার মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানকেই। চা-কফি-স্টার্টারের পাশে হাজির হল বইয়ের স্টল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন জুনিয়র ও বন্ধুরাই এই বই বিক্রির দায়িত্ব নেন। মাঝে মাঝে সেখানে যোগ দেন ঋতায়নও। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লিও টলস্টয়— কার বই ছিল না সেখানে? সেখান থেকেই সাড়ে তিন হাজার টাকার বইও বিক্রি হয়ে গেছে! এমন উদ্যোগ আর কটা বিয়েবাড়িতে দেখা গেছে? আদৌ দেখা গেছে কি?

আরও পড়ুন
নতুন-পুরনো বইয়ের সঙ্গে চায়ের মৌতাত, কলেজ স্ট্রিটের নতুন ঠেক ‘এক কাপ চা’

অবশ্য শুধু এই ব্যাপারেই নয়। গোটা অনুষ্ঠানটাই ছিল সমস্ত শৃঙ্খল থেকে মুক্ত। এমনিতে ঋতায়ন আর সেমন্তীর বিয়ে বলতে শুধু রেজিস্ট্রিই হয়েছে। প্রথাগত কোনো অনুষ্ঠানের বালাই ছিল না। ডাকা হয়নি কোনো পুরোহিতকেও। সেটা চানওনি ঋতায়ন। অনুষ্ঠান বলতে ছিল বৌভাতের। বিয়ে উপলক্ষে নয়, সেই বৌভাত উপলক্ষেই ছাপা হয়েছিল কার্ড। বৌভাতের দিনই বৈদিক মন্ত্রের বঙ্গানুবাদ পাঠ করে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। ঋতায়নের একটাই উদ্দেশ্য, তিনি আদ্যোপান্ত বাঙালি। এই বাংলা ও এখানকার ভাষা তাঁর প্রাণ। তাই বিয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানে যেন সেই বাংলার ছোঁয়া থাকে। অনুষ্ঠানবাড়ির সজ্জা, কনের সাজ থেকে শুরু করে সবেতেই যেন উঠে এসেছিল এক টুকরো বাংলা।

আরও পড়ুন
দু-বাংলার সেতু হয়ে হাজির প্রহর, একুশে বইমেলার আড্ডায় জয়ী হল ভাষাই

সেই সঙ্গে ছিল বাংলা বই। বৌভাতের অনুষ্ঠান এভাবেই ভরিয়ে দিলেন তিনি। আর তাঁর এই উদ্যোগ প্রশংসিত হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। দিনের শেষে যাতে আরও মানুষ এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন; বাংলা বই যাতে আরও মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায়, সেটাই তাঁর স্বপ্ন। ঋতায়ন চট্টোপাধ্যায়কে দেখে আরও মানুষ যদি এগিয়ে আসেন এমন অভিনব উদ্যোগ নিয়ে, তাহলে তো সেটা আমাদের বাঙালির জন্যই মঙ্গল হবে। সেটাই এখন চাইছে চট্টোপাধ্যায় পরিবার।

More From Author See More