“আমাদের ছোটো থেকে নিজেদের চারপাশকে আর কতটুকুই বা চিনতে দেওয়া হয়? ভূগোলে দেশবিদেশের বর্ণনা থাকে। কিন্তু নিজেদের শহর, নিজেদের জেলাকেই চিনে ওঠা হয় না। শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অভিভাবকরা সচেতন না হলে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানোও মুশকিল।” বলছিলেন মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা অরিন্দম ভৌমিক। সম্প্রতি তাঁর উদ্যোগেই পুনঃপ্রকাশিত হল ৮৮ বছর আগের একটি হারিয়ে যাওয়া বই। ‘মেদিনীপুরের সরল ভূগোল’। সম্ভবত বাংলার কোনো জেলার নিজস্ব ভূগোলকে ঘিরে লেখা প্রথম বই।
বইটির লেখক মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নারায়ণ কুমার মুখোপাধ্যায়।
মেদিনীপুর শহর তথা জেলার ইতিহাসের প্রতি বরাবর টান অরিন্দম ভৌমিকের। বলছিলেন, “বাংলার সব জেলারই বর্ণময় ইতিহাস রয়েছে। এই মেদিনীপুর জেলা থেকেই তো শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী নায়েব আন্দোলন। সেখান থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্যন্ত কম লড়াই দেখেনি মেদিনীপুর। কিন্তু এখানকার ছেলেমেয়েদের কাছেই আজ সেসব অজানা।” সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সন্ধান করে চলেছেন আজ ৫ বছর ধরে। এমনিভাবেই একসময় তাঁর মনে হয়, মেদিনীপুরের রাস্তাঘাট, নদীনালা থেকে শুরু করে সমগ্র জেলার একটা ভূগোলের ধারণাও থাকা প্রয়োজন। নানা বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিজেই লিখে ফেললেন একটা বই। “কিন্তু তখনই একটা জিনিস চোখে পড়ল, আমাদের হাতে যেসমস্ত বই আছে, তার লেখকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেরা গবেষণা করেননি। কোনো বরিষ্ঠ লেখকের গবেষণার সাহায্য নিয়েছেন। অথচ সেই মূল বইগুলি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।”
তেমনই একটি বই ‘মেদিনীপুরের সরল ভূগোল’। “লেখক নারায়ণ কুমার ছিলেন স্বদেশি আন্দোলনের শরিক। ১৯৩৩ সালে তিনি এই বই প্রকাশ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশের অত্যাচারে মেদিনীপুর ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। আর তাঁর লেখা বইয়ের সমস্ত কপি পুড়িয়ে দেয় পুলিশ।” বলছিলেন অরিন্দমবাবু। “তবে সমস্ত কপি তো পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব হয় না। অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজি করে কল্যাণী শহরের এক সংগ্রাহকের কাছ থেকে বইটির একটি জেরক্স কপি পাই। ৫ বছর লেগেছে এই অনুসন্ধান করতে। তবে হাল ছাড়িনি কখনোই।”
আরও পড়ুন
কমিউনিটি কিচেন থেকে আমফান-দুর্গতদের সাহায্য - ইন্দ্রাণী রায়-কে ভুলবে না বইপাড়া
বইটি সংগ্রহ করার পর নারায়ণ কুমার মুখোপাধ্যায়ের বংশধরদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন অরিন্দমবাবু। লেকটাউন নিবাসী তাঁর নাতনির কাছ থেকে লেখকের জীবন সম্পর্কে আরও নানা তথ্য জানতে পারেন। সেইসমস্ত তথ্য নিয়েই তৈরি হয় পুনঃপ্রকাশিত বইয়ের মুখবন্ধ। ২০ মার্চ মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের বটতলায় বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতি হিমানী পড়িয়ার উপস্থিতিতে বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান হয়। “বিক্রি হবে না ভেবে মাত্র ৩৫০ কপি বই ছেপেছিলাম। কিন্তু তিনদিন যেতেই সব বই শেষ। আবারও নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে হবে। তবে আমি একা কতটা করতে পারবো জানি না।” জানালেন অরিন্দম ভৌমিক। তবে শেষ পর্যন্ত একটা আক্ষেপ থেকেই যায়। ৮৮ বছর আগে যখন এই বই প্রকাশিত হয় তখন দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ছিল এটি। অর্থাৎ তখনকার ছেলেমেয়েরা ছোটো থেকে নিজের জেলাকে চিনতে শিখত। এখন একটা বড়ো অংশের ছেলেমেয়েই কিছু জানবে না। এই বিষয়ে সরকার এবং স্কুলগুলিকে উদ্যোগ নেওয়ার আবেদনও রেখেছেন অরিন্দম ভৌমিক।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মাতৃভাষা দিবসে বইপাড়ার নতুন ঠেক, অভিনব ভাবনা নিয়ে হাজির ‘বর্ণ-বইমহল’