কবিতাই তাঁর প্রতিবাদের অস্ত্র, বইমেলায় প্রকাশিত হল প্রসূন ভৌমিকের বই

বইমেলা মানে বাঙালি বই পাঠকের সবথেকে বড়ো উৎসব। আর সাহিত্য যখন সমাজের আয়না, তখন সমাজের নানা প্রান্তের মানুষের প্রতিদিনের লড়াই আন্দোলনের একটা ছবি অন্তত বইমেলায় খুঁজে পাওয়া যাবেই। এই মুহূর্ত, এই সময়কে ধরতে সেরকমই একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল 'বিজল্প' প্রকাশনী। গতকাল, ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটে থেকে কলকাতা বইমেলার এসবিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হল কবি প্রসূন ভৌমিকের কবিতার বই 'আগলে রাখো'র প্রকাশ অনুষ্ঠান ও তাকে কেন্দ্র করে একটি আলোচনা সভা, 'এইসময়'।

বাঙালি পাঠকের কাছে একটি পরিচিত নাম প্রসূন ভৌমিক। সেই নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেই প্রতিদিনের পথ-ঘাটের সঙ্গে বইয়ের দুই মলাটকে মিলিয়ে দেওয়ার আহ্বান নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। একটি পত্রিকার আকারে পথ চলা শুরু করে 'বিজল্প', তারপর ক্রমশ শুরু হয় পুরোদমে বই প্রকাশের কাজ। আর 'বিজল্প' মানে, কবির কথায়, বিশুদ্ধ সাহিত্যের সঙ্গে বিশুদ্ধ প্রতিবাদ। কবিকে তাই এর আগেও আমরা দেখেছি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের কৃষকদের পাশে গিয়ে কবিতা লিখতে। আর এইসময় সিএএ বিরোধী আন্দোলনের পাশেও আমরা দেখেছি তাঁকে। কবিতার বই 'আগলে রাখো' কে সেই আন্দোলনের দলিল হিসাবেই পরিচিত করতে চান তিনি।

বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গায়ক, গীতিকার, সুরকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত, মানবাধিকার কর্মী রবি নায়ার এবং অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দে। বইমেলায় নানান ব্যস্ততার মধ্যে খুব অল্প সময় থাকতে পেরেছেন প্রচেত গুপ্ত। তাই কবির নিজের মুখে কবিতাপাঠের রেশ যখন দর্শকরা কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তখনই ডায়াসে দাঁড়িয়ে শুধু একটি কথাই বলে গেলেন তিনি। অন্য একজন সাহিত্যিক হিসাবে নয়, প্রসূন ভৌমিকের কবিতার দীর্ঘদিনের পাঠক হিসাবে তিনি বললেন, "ওর (প্রসূনের) কবিতায় সবসময় ওর মতাদর্শ, ওর বিশ্বাস উপস্থিত থাকবে। কিন্তু তার জন্য কখনোই কবিতার শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ হয় না। পাঠক কবিতার কাছে যা খোঁজে, তার সবটাই খুঁজে পাওয়া যায় ওর কবিতায়।"

কবি নিজে বারবার রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের কথা বললেও, বইমেলায় সাহিত্যের আসরে তা যেন বেমানান লাগে না। বিশুদ্ধ প্রতিবাদের কথা বললেও যেমন প্রসূন ভৌমিকের কবিতা শেষপর্যন্ত বিশুদ্ধ সাহিত্য, তেমনই তো প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান। সিএএ আইনের বিরুদ্ধে প্যারোডিও লিখে ফেলেছেন তিনি। সেই প্যারোডির সঙ্গেই আজকের অনুষ্ঠানে আরও পাঁচ-ছ’টি গানও গাইলেন তিনি। অনুষ্ঠানের কিছুক্ষণ আগেই মেলার মাঠে বসে কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতা 'আগলে রাখো'র কথায় সুর বসিয়ে গান বেঁধে ফেলেছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

এভাবেই, গানে কবিতায় একসময়কার প্রতিবাদের ভাষা যখন উঠে আসছিল, তখন রবি নায়ার উঠে বললেন, "হামকো তো ইঁহা নেহি হোনা চাহিয়ে।" মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইতে রাস্তায় থাকতেই অভ্যস্ত তিনি। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ভাষা যখন বইয়ের দুই মলাটে উঠে আসে, তখন সেই মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে ছুটে আসেন তিনি। সাহিত্যের আঙিনায় পা রাখতে না পারলে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যায় বলেই মনে করেন মানবাধিকার কর্মী রবি নায়ার।

আর সবশেষে অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দে বলেন কবিতার আড়ালে থাকা মানুষ প্রসূন ভৌমিকের কথা। সেইসঙ্গে বললেন সংবিধান ও মানবাধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে কেন তাঁরা এনআরসি এবং সিএএ আইনের বিরোধিতা করছেন। তাঁর কথায় উঠে আসে সেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্যায় থেকে আজ পর্যন্ত জনতার প্রতিবাদের পাশে থাকার নানান স্মৃতি। সেই আবেগঘন স্মৃতিচারণার সঙ্গে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের সুরে অনুষ্ঠান শেষ হয়। সবশেষে মনে হয় যেন কবিতার দর্পণে আসলে শাহিনবাগ বা পার্ক সার্কাসের আন্দোলনেরই উত্তরপুরুষ হয়ে উঠল কলকাতা বইমেলার এই অনুষ্ঠান।

Latest News See More