মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শুকনো পাতা। তার ওপরে বিছানো সাদা চাদরে অসংখ্য বই। আর তাদের ঘিরেই রৌদ্রস্নাত বিকেলে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। পড়ে দেখছেন, আলোচনা করছেন, সযত্নে হাতে তুলে নিচ্ছেন দুই মলাটে বন্দি অক্ষর। না, কোনো বইমেলা নয়। এই উৎসব ‘বই বিনিময়’-এর। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরে আয়োজিত হল এমনই অভিনব একটি ‘মেলা’। বাংলাদেশে এমন উদ্যোগ এই প্রথম তো বটেই, তাছাড়াও বাংলা ভাষার বই বিনিময়ের এমন উৎসব আর কোথাও ইতিপূর্বে হয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশেরই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘বইবন্ধু’-র উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল এই উৎসব। দিনটা ছিল গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল অনলাইন বই বিক্রেতা সংস্থা রকমারি ডট কম, আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছে ইভেলি ডট কম। তাছাড়াও স্থানীয় প্রশাসনের ধানমন্ডি জোনের পুলিশ প্রধান এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও বিভিন্নভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত। সেইসঙ্গে বিগত দু’সপ্তাহ ধরে এই মেলার প্রস্তুতিতে ঘাম ঝরিয়েছেন শ-খানেক স্বেচ্ছাসেবকও।
কিন্তু হঠাৎ এমন একটি উৎসবের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কোন চিন্তাভাবনা? উত্তর দিলেন উদ্যোক্তারাই। ‘বইবন্ধু’-র মূলত সমন্বয়ক মহিনুদ্দিন তোহা-র কথায়, ‘কানাডার টরোন্টো শহরে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে এই ধরণের একটি উৎসব হয়। ওখানে প্রকাশক, লেখকরা রাস্তায় বই সাজিয়ে দেয়। তুলনা করা হয় লিটারেচারের এই ট্রাফিকটা বেশি নাকি যানবাহনের। সেই উৎসব থেকেই ধারণা এসেছিল, এমনটা তো হতে পারে বাংলাতেও।’
আরও পড়ুন
বাতিল বই কুড়িয়েই আস্ত লাইব্রেরি, কলম্বিয়ার ‘বইয়ের রাজা’ এক সাফাইকর্মী
অন্যদিকে সহ-সমন্বয়ক রাশিব আহম্মেদ জানালেন, ‘আমরা এই উৎসবটা শুরু করতে চেয়েছিলাম ২০১৮ সালে। আসলে আমরা এখন ভার্চুয়াল জগতে বইয়ের থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। মানুষকে বইয়ের কাছে নিয়ে আসা, বইকে সহজলভ্য করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা থেকেই এই উদ্যোগ ছিল বইবন্ধুর।’
কথায় কথায় উঠে এল পরিসংখ্যানও। সব মিলিয়ে একদিনে আদান-প্রদান হয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি বই। জড়ো হয়েছিলেন আড়াই হাজারের মতো মানুষ। এক কথায় ‘বিপুল’ বললেও কি ভুল বলা হয় একে? প্রাথমিকভাবে এক হাজারেরও বেশি বই নিজেরা সংগ্রহ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। সেটাই ছিল এই উৎসবের মূল ‘পুঁজি’। ক্রমে পাঠকরা এসে তাঁদের ব্যবহৃত বই এনে বদল করে নেন এইসব বইয়ের সঙ্গে। চক্রাবর্তে ঘুরতে থাকে এই প্রক্রিয়াই। সবথেকে বড়ো কথা, ধরে নেওয়া যেতেই পারে এই ১৫ হাজার বই আসলে স্রেফ জমে ছিল পাঠকদের বইয়ের তাকে। ধুলোর আস্তরণ ছেড়ে তারাও তো খুঁজে পেল নতুন পাঠকের আদর। খিদে মেটাল বহু মানুষের।
আরও পড়ুন
তিনটি বইয়ের প্রতিটি শব্দেরই আদ্যক্ষর ‘ক’, অভিনব সাহিত্য রচনা বাঙালি লেখকের
ঠিক এই কথাটাই উঠে এল রাশিব আহম্মেদের কথাতেও, ‘আসলে বই পড়া হয়ে গেলে আমরা বইটা বাসায় ফেলে রাখি। যতক্ষণ পাঠক বইটি পড়ে ততক্ষণ তার প্রাণ থাকে। আর যদি বইটা বাসায় শুধুই গুছিয়ে রেখে দেওয়া হয়, তবে তার কোনো দাম থাকে না। আমরা চেষ্টা করছিলাম বইয়ের প্রাণটা ফিরিয়ে আনার। বিনিময়ের মাধ্যমে বইগুলোর যেমন ব্যবহার হবে, তেমনই পাঠকের সঙ্গে পাঠকের মধ্যে যোগাযোগও গড়ে উঠবে একটা।’
আরও পড়ুন
মাদাগাস্কারে ভারতীয় লেখকদের বই নিয়ে স্ট্রিট লাইব্রেরি
যোগাযোগ গড়ে তোলার সেই উদ্দেশ্য যে একশো শতাংশ সফল হয়েছে, তাতে সন্দেহের জায়গা নেই কোনো। আসলে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে বইয়ের মাস। ভাষা দিবসের দিনই ঢাকায় শুরু হয়ে যায় একুশে বইমেলা। কিন্তু মহামারীর আবহে মাস খানেকের জন্য পিছিয়ে গিয়েছে সেই সূচি। সেদিক থেকে পাঠকদের মধ্যে ‘নতুন’ বইয়ে রেশ আরও একবার জাগিয়ে তুলল বই বিনিময় উৎসব। হয়ে উঠল বইকে কেন্দ্র করে উন্মত্ততা আর যোগাযোগের মাধ্যমও।
তবে, এই পথ চলার সবে শুরু। আগামীদিনে শুধু ঢাকাই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন ডিভিশনে, বিভিন্ন শহরেই এই ধরণের উদ্যোগে পরিকল্পনা রয়েছে ‘বইবন্ধু’-র। আনন্দের সঙ্গেই উদ্যোক্তা মহিনুদ্দিন তোহা জানালেন, ইতিমধ্যেই পাঠকদের থেকে আসতে শুরু করেছে অনুরোধ। প্রতি দু’মাস অন্তরই যাতে আয়োজিত হয় এমন অনুষ্ঠান, সেই দাবিও উঠে এসেছে অনেকের থেকে। সব মিলিয়ে একদিনের এই ছোট্ট অথচ বিরাট বিনিময় উৎসব রীতিমতো উন্মাদনায় ভাসিয়েছে বাঙালি পাঠকদের…
Powered by Froala Editor