ছোটবেলা থেকেই স্কুলের বা পাড়ার লাইব্রেরিতে দেখেছেন জ্বলজ্বল করছে 'নিঃশব্দে পড়ুন' বা 'Keep Silence'। ছোটবেলার স্কুল লাইব্রেরিতে সেই নিয়মের লঙ্ঘন কমবেশি সকলেই করেছি আমরা। ওই 'নিঃশব্দে পড়ুন' লেখা বোর্ডের সামনেই ফিসফিসিয়ে গপ্পো জুড়েছি। কিন্তু এই লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার যাই বলুন, নিঃশব্দে মানুষের মনকে খোরাক জুগিয়ে গেছে বছরের পর বছর ধরে। আগামীকাল ১০০ বছরে পা দিতে চলেছে এমনই এক গ্রন্থাগার, বনহুগলি লাইব্রেরি দশ দশটি দশক কাটিয়ে নিজের শততম জন্মদিন পালন করছে এই ২০১৯ সালে।
তখন বনহুগলি গ্রামীণ এলাকা। চারদিকে জল-জঙ্গলে ভরা, শেয়ালের ডাক শোনা যায় ইতিউতি। জনবসতিও খুব বেশি ছিল না। এমন পরিস্থিতিতেও, গ্রামে শিক্ষার প্রসারের জন্য লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন কয়েকজন। আশেপাশের সমস্ত জনপদ - বেলঘরিয়া, আড়িয়াদহ, দক্ষিণেশ্বর, বরানগরে ততদিনে তৈরি হয়ে গেছে লাইব্রেরি। বাকি ছিল বনহুগলিই। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও, এই লাইব্রেরির আরো দু'বছর লেগেছিল নিজস্ব আস্তানা তৈরি করতে। ১৯২০ সালে তাঁদের নিজস্ব ভবনটি তৈরি হয়। আরো দু'বছর বাদে হয় রেজিস্ট্রেশন। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন টি সি মুখার্জি, এইচ বি ব্যানার্জি, এ এম মৈত্র, এন এন ভট্টাচার্য, দেবেন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, এইচ ডি মুখার্জি, ভূতনাথ চক্রবর্তী, কানাইলাল আউল, সতীশচন্দ্র আউল, ডি এল মৈত্র। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন বি. এল ঢোল, টি এম মল্লিক, বিখ্যাত শিল্পী অশী গাঙুলী,পাঁচু গোপাল চক্রবর্তী যিনি কিনা বরাহনগর মিউনিসিপালিটির প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। নিজের মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে ফকিরচন্দ্র ঘোষ লাইব্রেরিকে জমি দান করেছিলেন। ১ কাঠা ৮ ছটাক সেই জমির ওপরই গড়ে উঠেছিল 'জগৎমোহিনী হল'।
হাজার দশেকের কাছাকাছি বই থাকা এই লাইব্রেরিতে বৈচিত্রও কম নেই। বহু দুর্মূল্য পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, গবেষণামূলক পুস্তক ছাড়াও আছে গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা, ধর্মপুস্তক, পুরাণ, বিভিন্ন অভিধান, ভ্রমণ সাহিত্য, কবিতা, শিশু ও কিশোরদের জন্য আকর্ষনীয় বই। ৩১০ জন সাধারণ সদস্য ও ৪২ জন শিশু সদস্য নিয়ে বেঁচে থাকা এই লাইব্রেরি প্রতিদিন তার জৌলুস বাড়াচ্ছে,বাড়ছে তাদের সদস্য সংখ্যা। বৃদ্ধি পাচ্ছে দৈনিক পাঠক সংখ্যাও। ১৫ জন পাঠক রোজ নিয়মিত আসেন এখানে। উত্তর শহরতলির এই গ্রন্থাগারে পা রেখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অখিল নিয়োগী প্রমুখ জ্যোতিষ্করা।
লাইব্রেরির দেওয়ালে রয়েছে ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সচরাচর পশ্চিমবঙ্গের কোনো লাইব্রেরিতে এমন ফলক দেখতে পাওয়া যায় না। সেদিক দিয়ে বনহুগলি লাইব্রেরি অবশ্যই ব্যতিক্রম।
শতবর্ষের আলোয় উজ্জ্বল এই লাইব্রেরি উদযাপনে ঘাটতি রাখেনি কোথাও। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর আয়োজন করা হচ্ছে এমন এক অনুষ্ঠান, যাতে মিশে যাবেন দুই বাংলার সাহিত্যিক, সংস্কৃতিপ্রবণ মানুষরা। গত ২২ সেপ্টেম্বর জেলার ইতিহাস, পুরুলিয়ার ঐতিহ্যকে মনে রেখে এলাকায় ছৌ নাচ সহ একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজে জুড়ে আছে এই প্রতিষ্ঠান। নিয়মিত নাট্যচর্চাও হয়ে থাকে এখানে। নান্দীকারের পৃথা চ্যাটার্জি, অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এখানকার নিয়মিত পাঠক।
আগামী প্রজন্মকে বইমুখী করে তোলার পাশাপাশি বরাহনগর অঞ্চলের সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েদের কাছে একটি মঞ্চ গড়ে দেওয়াই লক্ষ্য লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের। এছাড়া বিভিন্ন ডিবেট কম্পিটিশন, ক্যালিগ্রাফি কম্পিটিশন করার ভাবনাও আছে তাঁদের কাছে। বহু পুরোনো লাইব্রেরি পত্রিকা 'এবং সাহিত্যম'-কে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে শতবর্ষের মলাটে। যা বহুদিন বন্ধ ছিল আর্থিক প্রতিকূলতার ফলে। এছাড়াও ছোটদের জন্য পত্রিকা 'লালিত্য'ও নতুন করে প্রকাশ করার ভাবনা আছে তাঁদের। ২৯ সেপ্টেম্বর বহু প্রতিক্ষিত গ্রন্থ তালিকাও প্রকাশ করা হবে লাইব্রেরির তরফে।
রবিবার ছাড়া লাইব্রেরিটি প্রতিদিন খোলা থাকে সন্ধে ৬.৩০ থেকে ৯টা পর্যন্ত। শুধুমাত্র সদস্যদের ডোনেশনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রবীণ লাইব্রেরি কোনরকম সরকারি সাহায্য ছাড়াই কাটিয়ে দিয়েছে এতকাল একবুক বই আর অভিমান নিয়ে। পাওনা বলতে একমাত্র ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি অফিস থেকে বছরে ২৫ হাজার টাকা। মাত্র ২০ টাকা সদস্য চাঁদায় চলা এই বইঘর নিতান্তই মনের পুষ্টি জোগাতেও বহু দুষ্প্রাপ্য বই বাড়িয়ে দেবে হাতের নাগালে।
পিডিএফের রমরমার যুগে, যখন সামগ্রিকভাবে কমছে বইয়ের পাঠক, তখনও আগামী নিয়ে আশাবাদী বনহুগলি লাইব্রেরি। দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করে চলেছে পাঠ-বিমুখতার বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে, এই বা কম কী!