বলিভিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম ভালেগ্রান্দেতে হাজির হলেন কয়েকজন চিত্রসাংবাদিক। চলেছেন অজানা এক গন্তব্যে। তাঁদের সামনে-পেছনে বেশ কয়েকজন সশস্ত্র বলিভিয়ান সৈনিক। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা? কী দেখানোর আছে? আশঙ্কা আর দোলাচল ভিড় করে আসছে সাংবাদিকদের মনের ভেতর। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সামনে দেখলেন একটি ছোট্ট হাসপাতাল। সেখানে ঢোকার পর নিরাপত্তার বহর আরও বেড়ে গেল। ক্যামেরা তৈরি করে রাখলেন সাংবাদিকরা। এই ঘর, ওই ঘরের পর হাজির হলেন হাসপাতালের লন্ড্রিতে। ভেতরে লোহার স্ট্রেচারে শোয়ানো রয়েছে একটি দেহ। ফর্সা, খালি গা, পরনে কেবল ময়লা কালো প্যান্ট। কোঁকড়ানো চুল আর দাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিস্পলক চোখ দুটো। দেহে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। চিত্রসাংবাদিকরা বেশ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁদের সামনে, হাসপাতালের স্ট্রেচারে মৃতদেহ হয়ে শুয়ে আছেন চে গেভারা। ঠান্ডা মণির ভেতর তখনও ধিকিধিকি জ্বলছে বিপ্লবের আগুন…
চল্লিশের দশকের শেষের দিক। আর্নেস্টো গেভারা দে লা সেরনা চলে গেলেন ডাক্তারি পড়তে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ারসে দিব্যি চলছিল পড়াশোনা। ছোটো থেকেই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন আর্নেস্টো। ভালোবাসতেন কবিতার ভেতর ডুবে থাকতে। কখনও অন্য কবির লেখা পড়তেন, কখনও নিজেই লিখতেন। একবার ঠিক করলেন, পুরো লাতিন আমেরিকা ঘুরে দেখবেন। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। কিন্তু কাজটি করতে গিয়ে এত তিক্ত অভিজ্ঞতা হবে, ভাবতে পারেননি। যেদিকে তাকাচ্ছেন, দেখছেন অর্ধনগ্ন, হাড় জিরজিরে মানুষদের ভিড়। পেটে খাবার নেই, পকেটে টাকা নেই। অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে মৃত্যু। সমাজের একটা বড়ো অংশ ক্রমশ সেঁধিয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের ভেতর। আর তাঁদের শরীরের ওপরই বেড়ে উঠছে সাম্রাজ্যবাদ। চলছে পুঁজির খেলা।
এই দৃশ্যই ডাক্তারি ছাত্রটির চেহারা বদলে দিল। ডাক্তারের সাদা পোশাক আর স্টেথোস্কোপ ছেড়ে পরলেন খাকি পোশাক। মাথায় টুপি, হাতে নিলেন বন্দুক। আর্নেস্টো গেভারার খোলস ছিঁড়ে জন্ম নিলেন চে গেভারা। চোখে তাঁর স্বপ্ন, শিরায় শিরায় বইছে আগুন— বিপ্লবের আগুন! ততদিনে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেছে তাঁর। দুজনে মিলে লাতিন আমেরিকায় গেরিলা ঝড় তোলার দিকে এগোলেন। কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া— সব জায়গায় চে-র ছবি, জামায় তাঁর মুখের প্রতিকৃতি, দেওয়ালে স্টেনসিলে তিনি আজও জীবিত। কিন্তু কেমন ছিল শেষের সেই দিন?
১৯৬৭ সালের ৮ নভেম্বর। ফেলিক্স রডরিগেজ নামের এক কিউবান-আমেরিকান সিআইএ এজেন্ট হাজির হন লা হিগুইরার একটি স্কুলে। ভেতরেই একটি ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসেছিলেন চে। জামা ছেঁড়া; চুলে, মুখে, শরীরে বলিভিয়ার ধুলো-কাদা লেগে আছে। ক্লান্ত চোখে তাকালেন ফেলিক্সের দিকে। আগের দিনই একটি গুলি লেগেছিল পায়ে। বলিভিয়ার সশস্ত্র সৈন্যরা তাঁর দিকে এগোলে জোরে চিৎকার করেছিলেন “হ্যাঁ আমিই চে গেভারা। আমাকে মেরো না। আমাকে জীবিত ধরলেই তোমাদের লাভ!” সেই গলা চিনতে পারবে না এমন মানুষ কি ছিল তখন পৃথিবীতে? আমেরিকা সরকার চেয়েছিল চে-কে বন্দি করে তাঁর থেকে তথ্য বের করতে। কিন্তু বলিভিয়ার সেনারা সেসব মানতে নারাজ। আগুনের গোলাকে বাঁচিয়ে রাখলে সে আবারও সব পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য বেরোবে। কাজেই তাঁকে চিরতরের জন্য ঠাণ্ডা করা দরকার…
বলিভিয়া থেকে সেইদিনই বেরোল একটি খবর। সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে নাকি প্রাণ হারিয়েছেন চে গেভারা! মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। কিউবায় বসে এমনটা মানতেই পারেননি ফিদেল কাস্ত্রো। তাঁর পরম বন্ধু হয়ত আত্মগোপন করে আছেন; সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এমন খবর প্রচার করা হচ্ছে। বাস্তব ছিল অন্যরকম। লা হিগুইরার স্কুলে ফেলিক্সের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত বন্দি চে গেভারা। তিনি কি জানতেন শেষ পরিণতি? হয়তো… না হলে এত ঠান্ডা, শান্ত থাকেন কী করে! এক অদ্ভুত অবস্থায় পড়লেন ফেলিক্স রডরিগেজ। কী করবেন এই মানুষটিকে নিয়ে? শেষ পর্যন্ত ঘরে উপস্থিত সৈন্যটিকে নির্দেশ দিলেন, বন্দুক তৈরি করো। হাতে, পায়ে আর গলায় ঢুকিয়ে দাও বুলেট। থামিয়ে দাও আগুনকে। এক… দুই… তিন… ঘরের ভেতর বেশ কয়েকবার গুলির আওয়াজ শোনা গেল…
মৃত্যু তো হল; কিন্তু তাঁর শরীর? চে গেভারার মতো বিপ্লবীর দেহ যাতে কারোর হাতে না পড়ে, তারই ব্যবস্থা নিল বলিভিয়া সৈন্য। ভালেগ্রান্দের একটি জায়গায় মাটি খুঁড়ে দাফন করা হয় ফর্সা দেহটি। তখনও রক্ত শোঁকায়নি। ফিদেল কাস্ত্রোকেও তো ঠান্ডা করতে হবে! তাঁকে চে’র মৃত্যুর প্রমাণ পাঠাতে হবে। অগত্যা, কাটো হাত! হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত মৃতদেহ থেকে দুটি হাতই কেটে নেওয়া হল। তারপর ফরমালিনে ডুবিয়ে রাখা হল, যাতে সুযোগ বুঝে তাঁর আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা যায়।
আরও পড়ুন
কিউবার ডাক্তারদের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব ইতালির
সময়ের চাকা ঘুরিয়ে যাওয়া যাক ১৯৯৭ সালে। গল্পের শেষ পর্যায়। প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেল, চে গেভারা নেই এই পৃথিবীতে। কিন্তু তাঁর সমাধির হদিশ এখনও পাওয়া গেল না। এই সময় জন লি অ্যান্ডারসন ঠিক করলেন, চে’র ওপর একটি জীবনী লিখবেন। এবার তাঁর কবরটিও তো খোঁজা দরকার! নতুন করে শুরু হল তল্লাশি। একসময় দলটি পৌঁছে গেল বলিভিয়ার সেই গ্রামটিতে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর খুঁজে পাওয়া গেল সেই জায়গা। পৃথিবীর আলো দেখল চে গেভারার দেহাবশেষ। ফিদেল কাস্ত্রো নিজের উদ্যোগে সেটা নিয়ে এলেন কিউবায়। সান্তা ক্লারায় শেষ সম্মান জানালেন বন্ধু, সহযোদ্ধা-কে। আর মহাকাল নতুন করে দেখছিল খাকি পোশাক, একমুখ দাড়ি, অবিন্যস্ত চুলের এক যুবককে। যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন কবিতার পৃথিবীর, স্বপ্ন দেখেছিলেন মানুষের, দেখেছিলেন বিপ্লবের আগুন পথ। ‘চে’ কেবলই একটি নাম নয়…
তথ্যসূত্র-
১) ‘চে গুয়েভারার রোমাঞ্চকর জীবন ও ভয়ংকর মৃত্যু’, জ্যাচ জক, প্রথম আলো
২) ‘‘Do not shoot!’: The last moments of communist revolutionary Che Guevara’, Kristine Phillips, The Washington Post
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ইতালির মৃত্যুমিছিল রুখতে এগিয়ে এলেন কিউবার ডাক্তাররা, সার্বিয়াকে সাহায্য চিনের